চলমান সংকট নিরসনের উপায় নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নূরুল আমিন ব্যাপারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল ও সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপিকা সাদেকা হালিম। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোনোভাবেই বল প্রয়োগ কাম্য নয়। সমস্যা যেহেতু নির্বাচন নিয়ে, তাই প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকেই সদিচ্ছার মনোভাব নিয়ে আলাপ-আলোচনায় বসতে হবে। বন্ধ করতে হবে জ্বালাও-পোড়াওসহ সহিংসতা। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা জরুরি। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন তারা। এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বর্তমান সমস্যার সূত্রপাত রাজনীতি থেকে। তাই এটা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। যদিও এখন রাজনীতিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে। এগুলো আইনানুগভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের দাবিগুলোর প্রতি সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। সংকট মোকাবিলায় দেশের প্রধান দুই দলকেই সদিচ্ছার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। চলমান সংকট নিরসনে প্রাথমিক পর্যায়ে দুই দলের নির্ভরযোগ্য নেতাদের আলোচনায় বসা উচিত। সবশেষে প্রধান দুই নেত্রীকেই সরাসরি বৈঠক করে দেশের চলমান সমস্যার সমাধানের পথ বের করতে হবে। মূলত দুই নেত্রীর সদিচ্ছার ওপরই সংকট সমাধান অনেকাংশে নির্ভর করছে।’
টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান যে সংকট তা রাজনৈতিক। যদিও দেশে সুস্থ রাজনীতি নেই। যা হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছেই। তাই বর্তমান সংকট উত্তরণের চাবিকাঠি দুই নেত্রীর হাতে। দেশের মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। দেশের মানুষ যে ধরনের সংলাপ-সমঝোতা চায়, তা আমলে নিতে হবে।’
দেশের বর্তমান অবস্থা সুখকর নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বাড়বে। সে পরিস্থিতি থেকে ফিরে আসা আমাদের জন্য কঠিন হবে। অগণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ ঘটবে। উগ্রপন্থিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যা দুই দলের জন্যই চরম ক্ষতিকর হবে। এ বিষয়গুলো দুই নেত্রীকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।’ প্রধান দুই দলকে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকা উচিত বলেও মন্তব্য করেন ড. ইফতেখার। তার মতে, বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিক সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দিতে হবে। নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ‘মিথ্যা’ মামলা তুলে নিতে হবে। আর যারা প্রকৃত দোষী তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এফবিসিসিআইর সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘চলমান যে সংকট, তাতে সহিংসতার মাত্রাই বাড়বে, কমবে না। দুই নেত্রীর ওপর আমাদের ভরসা থাকলেও এই মুহূর্তে তারা বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন। ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে একনেত্রীর প্রতি আমাদের আহ্বান, এই মুহূর্তে জ্বালাও-পোড়াও সন্ত্রাস বন্ধ করুন। সেক্ষেত্রে আরেক নেত্রীকে আমরা বলতে পারি, আপনি এবার আলোচনায় বসুন। সমাধানের পথ খুঁজুন। আমরা মনে করি, বিপরীত মেরুতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত দুই নেত্রীই ভরসা। পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে আমরা শিগগিরই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করব।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নূরুল আমিন ব্যাপারীর মতে, ‘বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটোই শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে, আরেকটি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ঘিরে। বর্তমানেও দুই দলের হাল ধরেছেন তাদেরই উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়ার স্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। স্বাভাবিকভাবেই ২০ দলের কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করেন খালেদা জিয়া, আর ১৪ দলের সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। সুতরাং এই দুই নেত্রী যে সিদ্ধান্ত দেন, তা-ই দুই জোট বাস্তবায়ন করে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক যে সমস্যা তা অনেকটাই নির্বাচনকেন্দ্রিক। তাই বেগম জিয়ার সঙ্গে আলোচনা না করে প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবেন না। সদিচ্ছার মনোভাব নিয়ে দুই নেত্রী আলোচনায় বসলেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। ’৭০-এর নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানি সামরিক শাসকের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ীও হয়েছিলেন। তাই সংলাপের জন্য বর্তমান সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘আমাদের দেশ এখন কার্যত দুই ধারায় বিভক্ত। একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত রাজনৈতিক শক্তি। আর অন্যটিকে আমি বলব না তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। তবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দেশের অপর শীর্ষ নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে অংশটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই জোটে দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির রয়েছে। আমি মনে করি, মূল সমস্যাটি সেখানেই।’ তিনি বলেন, ‘এটি বলতেই হবে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দেশের জনগণ দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেত্রী যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ওপরই ভরসা রাখেন, অন্য কারও ওপর নয়। আমার বিশ্বাস, বিএনপি নেত্রী আজই যদি ঘোষণা দেন জামায়াতকে বাদ দিয়ে তারা সংলাপ চান তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপে বসবেন। সেক্ষেত্রে দেশের সুধীসমাজ, সচেতন নাগরিক সমাজ প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপে বসতে চাপ দেবে। কিন্তু জামায়াতকে সঙ্গে রেখে বিএনপি যদি সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসে সেক্ষেত্রে সংকট সাময়িক নিরসন হলেও একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা রয়েই যাবে। আমি মনে করি, সংকট যতই প্রকট হোক না কেন দেশের আপামর জনসাধারণ এখনো দুই নেত্রীর ওপরই ভরসা রাখছেন এবং আমিও ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী কেবল দুই নেত্রী আন্তরিক হলেই চলমান সংকটের সমাধান সম্ভব।’ সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপিকা সাদেকা হালিম বলেন, ‘দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশে যে নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, পেট্রলবোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে তা নিশ্চয়ই উদ্বেগজনক। আমরা অনেক আগে থেকেই যা বলে আসছি দেরিতে হলেও অর্থমন্ত্রীও দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে একই কথা বলেছেন। এ অবস্থায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিন্তু কাটছে না। এ কারণেই দেশবাসী চায় দ্রুত সমস্যার সমাধান। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি দুই প্রধান রাজনৈতিক জোট অনড় অবস্থানে থাকলেও দুই নেত্রীর কাছেই রয়েছে সমাধানের চাবিকাঠি। পরিস্থিতির আলোকে কেউ কেউ দুই নেত্রী কিংবা আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিকল্প ভাবলেও আমি তা মনে করি না।’ তিনি বলেন, ‘দেশের রাজনীতির দিকে যদি তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই, এ দেশের রাজনীতি অনেকটা পরিবার এবং দুই দলকেন্দ্রিক। আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এখনো কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠেনি। তাই দেশের জনগণ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে দুই নেত্রীর দিকে। সমাধানও তাদেরই হাতে।’
Leave a Reply