বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে নিয়োজিত একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভির হাসান জোহাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বুধবার দিনগত রাত ১টার দিকে রাজধানীর ভাসানটেকে জোহাকে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে জানিয়েছে তার স্বজনরা।
এর আগে সোমবার জোহা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি নিয়ে প্রকৃত তথ্য সংবাদ মাধ্যমের কাছে প্রকাশ করায় একটি মহল তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। তাই তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
জোহার স্বজনরা জানান, বুধবার রাত ১২টার দিকে স্ত্রী ডা. কামরুন্নাহারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন জোহা। এরপর অফিস থেকে বেরিয়ে সিএনজি অটোরিকশায় ওঠে কলাবাগানের লেক সার্কাসের ১৮/৩ নম্বর বাসার দিকে রওনা হন তিনি।
অটোরিকশাটি ঢাকা সেনানিবাসের কচুক্ষেতে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই কার্যালয়ের কাছে পৌঁছালে দুই-তিনটি গাড়ি এসে গতিরোধ করে। এরপর অটোরিকশা থেকে জোহাকে নামিয়ে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ওই সময় জোহার সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু ইয়ামির আহমেদ। তিনিই ফোন করে অপহরণের খবর পরিবারকে জানান বলে জানান জোহার চাচা মাহবুবুল আলম।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক উপমহাপরিচালক মাহবুবুল আলম জানান, খবর পাওয়ার পরপরই তারা কলাবাগান থানায় গিয়ে পুলিশকে ঘটনা জানান। এ সময় পুলিশ জানায়, অপহরণের এলাকা কাফরুল থানা এলাকায়। সেখানে গেলে কাফরুল থানা পুলিশ তাদের ক্যান্টনমেন্ট থানায় পাঠায়। সেখান থেকে পুলিশ আবার তাদের পাঠায় ভাসানটেক থানায়। তবে ভাসানটেক থানা পুলিশও দাবি করে এই ঘটনাস্থল তাদের এলাকায় পড়ে না। এরপর তারা বাসায় ফিরে যান।
ঘটনার ব্যাপারে জানতে কাফরুল থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) এমদাদুল হক যুগান্তরকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে মাহবুবুল আলম নামে এক ব্যক্তি এসে জানান তার আত্মীয় জোহা গতকাল রাতে নিখোঁজ হয়েছেন। পরে তিনি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে কথা বলেন।
কাফরুল থানার ওসি শিকদার মোহাম্মদ শামীম হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মাহবুবুল আলমের অভিযোগ পেয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ঘটনাস্থল ভাসানটেক থানার মধ্যে পড়েছে। পরে তাকে ভাসানটেক থানায় পাঠিয়ে দেই।
ঘটনাস্থলের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ঢাকা সেনানিবাসে ডিজিএফআইয়ের ডিটাচম্যান্ট অফিস সংলগ্ন সেনানিবাস মসজিদের আগের রাস্তায় ঘটনা ঘটেছে বলে মাহবুবুল আলম জানিয়েছেন।
পরে ভাসানটেক থানায় যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম রেজা বলেন, তাদের থানা এলাকায় এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই।
এদিকে অপহৃত জোহার স্বজন বেলায়েত হোসেইন যুগান্তরকে বলেন, অপহরণের ঘটনার পর জোহার পরিবারের সদস্যরা ভেঙে পড়েছেন। তার স্ত্রী কামরুন্নাহার বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করা হয়।
ঘটনা জানার পরও বিষয়টি গোপন রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এরপর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের দৈনিক দি ফিলিপিন্স ডেইলি ইনকোয়ারারের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির খবর জানায়। বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যমেও এ খবর এলে তোলপাড় শুরু হয়।
পরে গত ৭ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা চুরির ঘটনা স্বীকার করে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করে, দেশের বাইরে থেকে হ্যাকাররা অর্থ চুরি করেছে।
কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ব্যাংকের ভেতরের চ্যানেলের লোক ছাড়া শুধু বাইরে থেকে কারও পক্ষে এ বিশাল অর্থ চুরি করা সম্ভব নয়।
জোহা ডাক, টিলযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সাইবার নিরাপত্তা বিভাগ’ নামক প্রকল্পের পরিচালক (অপারেশন) ছিলেন। প্রকল্পটি দু’মাস ধরে বন্ধ আছে।
র্যাব বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্ত শুরু করলে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি।
সর্বশেষ গত রোববার বিকালে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও সেখানে যান।এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে র্যাবের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয়।
ওই বৈঠকে অর্থ চুরির ঘটনায় তদন্ত করা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সের প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি কনসালটেন্ট ভারতের নাগরিক রাকেশ আস্থানাও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে রাকেশ দাবি করেন, ঘটনাটি বাইরে থেকে ঘটানো হয়েছে। কিন্তু দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বলেন, ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই। আর এ বিষয়ে প্রযুক্তিগত সব প্রমাণও তাদের কাছে আছে।
এরপর সোমবার সকালে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘তানভীর হাসান জোহা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কেউ নয়’।মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছেরের স্বাক্ষরে বিজ্ঞপ্তিটি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়।
এতে বলা হয়, তানভীর হাসান জোহা নামের ওই ব্যক্তির কোনো কর্মকাণ্ড ও মন্তব্যের দায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের নেই। আলোচিত ওই রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের ঘটনা নিয়ে কোনও তদন্ত কমিটিও করেনি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। ওই ব্যক্তির যে কোনও মন্তব্য তার নিজ দায়িত্বের।’
এই বিজ্ঞপ্তির পর যোগাযোগ করলে জোহা বলেন, আমাকে চিঠি দিয়ে তদন্ত কাজে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রোববার রাতেও র্যাবের তদন্ত দলের সঙ্গে আমি ছিলাম। আমি র্যাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছি এবং তদন্তে সহায়তা করেছি।
তিনি বলেন, রোববার রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে এটা নিশ্চিত হয়েছি যে, রিজার্ভের সুইফট কোডের কম্পিউটার আলাদা ছিল না। এটা সাধারণ কম্পিউটারের সঙ্গেই ছিল। এই কম্পিউটারের আলাদা কোন নিরাপত্তা ছিল না।
জোহা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি নিয়ে প্রকৃত তথ্য সংবাদ মাধ্যমের কাছে প্রকাশ করায় একটি মহল আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। তাই তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা তদন্ত সহায়তা থেকে আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছে। কারণ আমি অনেক বিষয়েই প্রশ্ন তুলছি।
তিনি বলেন, আমি বিদেশী নাগরিকদের তদন্তে রাখা নিয়ে আপত্তি করেছি। কারণ আমি মনে করে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি হোল (গর্ত) তৈরি করেছে, আর এখন বিদেশী বিশেষজ্ঞদের হাতে তদন্তের নামে তথ্য তুলে দিলে আরও বড় হোল তৈরি হবে। আমি পুরো বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও জানাতে চাই।
তবে এর আগেই বুধবার রাতে নিখোঁজ হয়ে গেলেন এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। সূত্র:যুগান্তর
Leave a Reply