কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর হত্যাকাণ্ডের ১১ দিন অতিবাহিত হলেও এর কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায়নি আইনশৃংখলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তনুর ৪টি মোবাইলের কললিস্টের সূত্র ধরে ডিবি ও র্যাব পৃথকভাবে সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে। পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা সংস্থার হাতবদলের পর মামলা এবার সিআইডির উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত দলের কাছে। ২ দফা তদন্তকারী সংস্থা পরিবর্তন শেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মামলার নথি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
কুমিল্লা ডিবির ওসি একেএম মঞ্জুর হোসেন বলেন, মামলার যাবতীয় কাগজপত্র সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছেন কুমিল্লা সিআইডির পরিদর্শক গাজী মো. ইব্রাহিম। বৃহস্পতিবার দিনভর কুমিল্লা সিআইডি এবং ডিবি বুধবার প্রাপ্ত তনুর সুরতহাল রিপোর্ট, মোবাইল কললিস্টসহ মামলার পরবর্তী করণীয় নিয়ে বৈঠক করেন। পরে সন্ধ্যায় মামলার নথি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান : মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, তনুর হত্যাকারীরা যতই প্রভাবশালী হোক তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য প্রকৃত খুনিকে গ্রেফতার করা। তনুর মরদেহ যে জায়গাটিতে পড়েছিল, সেই জায়গাটি পরিষ্কার করা হয়েছে। এটি অস্বাভাবিক। লাশ উদ্ধারের পর ওই স্থানে ঘাস ও ছোট গাছ ছিল। কিন্তু পরে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, জায়গাটি পরিষ্কার করা হয়েছে। প্রকৃত অবস্থার এই পরিবর্তন কাম্য নয়। সাক্ষ্য আইন অনুযায়ীও সেটি কাঙ্ক্ষিত নয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লা সেনানিবাসে তনুর লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেই স্থান পরিদর্শন শেষে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে ড. মিজান এসব কথা বলেন। এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন তিনি। পরে তিনি তনুর বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সমবেদনা জানান। এ সময় তিনি তনু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনসহ মামলার তদন্তে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন।
কুমিল্লা সার্কিট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে তনুর দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত সম্পর্কে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে- কেন দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে? কমিশন মনে করে, দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের প্রয়োজন ছিল। কেননা, প্রথমবারে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। তিনি বিচারক ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে আহ্বান জানান, ‘প্রথমবার ময়নাতদন্তের সময় যদি কোনো গাফিলতি, তথ্য গোপনের চেষ্টা হয়ে থাকে, তবে এর সঙ্গে এবং পেছনে যারা যুক্ত তাদের বিচারের আওতায় আনুন।
কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, তদন্ত দলকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। যেখানে হয়েছে সেটা একটি বিশেষ এলাকা। সেখানে প্রবেশে বিধিনিষেধ আছে। এই বিধিনিষেধ যেন তদন্তে বাধা তৈরি করতে না পারে, সে জন্য সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানাব তদন্তের জন্য তারা যেন সব ধরনের সুবিধা দেয়। তিনি বলেন, মধ্যরাতে কেন তনুর বাবা, মা ও ভাইকে র্যাব ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করল, তা জানার অধিকার দেশের মানুষের আছে। এর আগে দুপুরে তিনি কুমিল্লা সার্কিট হাউসে পৌঁছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং তনু হত্যা মামলার বিষয়ে প্রশাসনকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।
তনুর পরিবারকে ন্যায়বিচারের আশ্বাস সেনাপ্রধানের : তনুর পরিবারকে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক। বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে পৌঁছেন। পরে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি প্রথমে তনু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তার বাসায় যান। এ বিষয়ে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন জানান, আমি সেনাপ্রধানের কাছে আমার মেয়ে হত্যার বিচার চেয়েছি। তিনি (সেনাপ্রধান) আমার পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছেন এবং হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছেন।
৪টি সিমের কললিস্ট সংগ্রহ : তদন্তকারী সংস্থাগুলো তনুর ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোনের ৪টি সিমের কললিস্ট ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সর্বশেষ তার মোবাইলে কল আসে। এসব কললিস্টের সূত্র ধরে তদন্ত কাজ চলছে বলে তদন্তকারী সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় সর্বশেষ তনুর মোবাইলে কল রিসিভ করা হয়। পৌনে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ১০টায় তনুর লাশ উদ্ধার পর্যন্ত তার অবস্থান কোথায় ছিল? তার মাথা থেকে চুল কেটে নেয়া, হিজাব খুলে ফেলা, হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত- এ সব কিছু খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী দল।
মামলা সিআইডিতে স্থানান্তও : তনু হত্যা মামলা ২ দফা তদন্তকারী সংস্থা বদলের পর মঙ্গলবার সরকারি নির্দেশ আসে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে হস্তান্তরের জন্য। সরকারি এ আদেশ আসার ৩ দিন পর অবশেষে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। এ বিষয়ে কুমিল্লা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার ড. নাজমুল করিম খাঁন বলেন, মামলার নথি হাতে পেয়েছি। এর রহস্য উদঘাটনে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ : তনু হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা এরই মধ্যে সন্দেহভাজনদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে।
র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন স্থান থেকে ওই আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে আটকের বিষয়টি কোনো তদন্তকারী সংস্থা স্বীকার করেনি। এ ঘটনায় এখনও কাউকে আনুষ্ঠানিক আটক করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ডিবি ও সিআইডি। এ বিষয়ে ড. নাজমুল করিম খাঁন বলেন, একটি স্পর্শকাতর এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে। তাই আমরা নিশ্চিত না হয়ে কাউকে গ্রেফতার করব না।
উল্লেখ্য, ২০ মার্চ রাতে তনুকে সেনানিবাস এলাকায় হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২১ মার্চ সন্ধ্যায় তনুকে তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে দাফন করা হয়। এ বিষয়ে তার বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন ২১ মার্চ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
Leave a Reply