ঈদের আগে কেনাকাটার জন্য পুরো মার্কেট ছিল জমজমাট। সব দোকানে ছিল ক্রেতার ভিড়। লিফটের সামনে দীর্ঘ লাইন। আবার কোনো কোনো দোকানে ইফতার আয়োজনের প্রস্তুতিও চলছিল। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের ট্রপিক্যাল আলাউদ্দিন টাওয়ারের চিত্র ছিল এমনই। তবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে হঠাৎ ১৭ তলাবিশিষ্ট ওই ভবনের লিফটের রশি ছিঁড়ে যায়। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো ভবন। আগুন ধরে যায় মার্কেটের একটি অংশে। ভেঙে পড়ে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা। শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি। লিফটের রশি ছিঁড়ে বেজমেন্টে পড়ার পর বিস্ফোরণ হয়। এতে বেজমেন্টের ওপর নির্মিত মসজিদের দেয়াল ধসে অপেক্ষমাণ কয়েকজনের ওপর আছড়ে পড়ে লিফট। চূর্ণবিচূর্ণ হয় লিফটের গ্গ্নাস ও দেয়াল। আগুন ধরে যায় লিফটেও। মর্মন্তুদ এই ঘটনায় নিহত হন পাঁচজন। তাদের মধ্যে দু’জন নারী ও তিনজন পুরুষ। আরও অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঈদের কেনাকাটার আনন্দঘন মুহূর্ত ঢেকে যায় বিষাদের কালো ছায়ায়। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।
দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন_ ট্রপিক্যাল হোমসের সিকিউরিটি ইনচার্জ মিজানুর রহমান রানা (৫২), লতা আক্তার (২৩), সালমা (৩৫), জসীমউদ্দিন (৩২), রেজাউল করিম (৩৫)। আহতদের মধ্যে একই পরিবারের তিনজন গুরুতর দগ্ধ হন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি বিধান ত্রিপুরা বলেন, নিহত পাঁচজনের মধ্যে একজনের মরদেহ স্বজনরা নিয়ে গেছেন। অন্যদের লাশ বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। নিহত সবার বিস্তারিত পরিচয় এখনও জানা যায়নি। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান জানান, লিফটের রশি ছিঁড়ে পড়ে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভবনটির বেজমেন্টে একটি নামাজের স্থান ছিল। লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়লে নামাজের ঘরের দেয়াল ভেঙে যায়। ভবনটি নির্মাণে প্রকৃত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ১৭ তলা ভবনের বেজমেন্টের তিনটি তলায় অবৈধ অনেক দোকান ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক মোজাম্মেল হক ঘটনাস্থল থেকে সমকালকে জানান, লিফটের রশি ছিঁড়ে পড়ার পর বিস্ফোরণ হয়। এরপর পাশের দেয়াল ধসে বেজমেন্টে অপেক্ষমাণ কয়েকজনের ওপর লিফট আছড়ে পড়ে। তবে লিফটের ভেতরে থাকা কেউ মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। বেজমেন্টের প্রথম তলায় অনেক এসি ছিল। সেখানে মিথেন গ্যাস জমা ছিল। তাই লিফটের তার ছেঁড়ার পর বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ধরে যায়। এ ছাড়া লিফটের পাশের দেয়াল দুর্বল ছিল। তাই লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়ার পর এর আঘাতে দেয়াল ভেঙে পড়ে।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে আলাউদ্দিন ট্রপিক্যালস টাওয়ার নির্মিত হয়। ১৭ তলা ভবনের ছয়তলা পর্যন্ত মার্কেট। সেখানে অন্তত তিন শতাধিক দোকান রয়েছে। ছয়তলা থেকে ওপরের দিকে আবাসিক ও কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পরিদর্শক মাহমুদুল হক সমকালকে জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট প্রায় একঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ১৭ তলা ভবনের বেজমেন্টে বসে অনেকে ইফতারির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ইফতারির ঠিক আগেই ওই দুর্ঘটনা ঘটে। উদ্ধার কাজের সময় রিয়াজউদ্দিন নামে এক দমকল কর্মী আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, ইফতারির কিছু আগে হঠাৎ করে বিকট শব্দ হয়। এ সময় দেখা যায় ১৭ তলাবিশিষ্ট আলাউদ্দিন টাওয়ারের একটি লিফটে বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ধরে যায়। এ সময় পাশের আরেকটি লিফটও ছিঁড়ে পড়ে। এতে কয়েকজন দগ্ধ হন। বিস্ফোরণে ওই ভবনে বেশকিছু কাচের দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। দুই লিফটের আশপাশের জায়গা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং কিছু ভাঙা কাচ ছিটকে মার্কেটের বাইরে রাস্তায় এসে পড়ে। অগি্নকাণ্ডের পর প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। এরপর আরও ৯টি ইউনিট তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, হাজার হাজার উৎসুক জনতা ভবনটিতে জড়ো হয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আশপাশে অবস্থান করছেন। ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। গুরুতর দগ্ধ একই পরিবারের তিনজনকে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন_ মাহমুদুল হাসান (৩৫), তার মেয়ে মাইশা (১০) ও ছেলে মুত্তাকিন (৮ মাস)। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল জানিয়েছেন, মাহমুদুলের শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে; মাইশার ৫৫ শতাংশ ও মুত্তাকিনের ২৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের তিনজনের অবস্থাই সংকটাপন্ন। দগ্ধদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন সোহান নামে এক ব্যক্তি। তিনি জানান, ভবনটির বেজমেন্টে ট্রপিক্যালস হোমস লিমিটেডের একটি জোনাল অফিস রয়েছে। মাহমুদুল হাসান ওই অফিসের এজিএম। তিনি দুই বাচ্চাকে নিয়ে ইফতার পার্টিতে এসেছিলেন। দগ্ধদের স্বজনের কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। মর্মন্তুদ এ ঘটনা কেউ মেনে নিতে পারছিলেন না।
মার্কেটের দোতলার ‘শান ফ্যাশন’ হাউসের মালিক শাহনাজ পারভীন সমকালকে বলেন, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে তিনি ধারণা করেন, বোমা বা এ জাতীয় কিছু বিস্ফোরিত হয়েছে। পুরো ভবন কেঁপে ওঠে। ভয়ে তিনি দ্রুত নিচে নেমে আসেন। নিচতলায় তখন ছিল অন্ধকার। আরও পরে তিনি জানতে পারেন লিফট ছিঁড়ে পড়ার কথা।
রাজলক্ষ্মী মার্কেটের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ জানান, তিনি মার্কেটের ভেতর থেকে ঘুরে এসেছেন। তার দাবি, শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। এতে মার্কেটের কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লিফটটি ‘বিস্ফোরিত’ হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, লিফট ছিঁড়ে পড়ার আগেই মার্কেটে অগি্নকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পুরো মার্কেটের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ার পর লিফট ছিঁড়ে পড়ে। মার্কেটটির এক ব্যবসায়ী জানান, ২০১২ সালেও একবার সেখানে আগুন ধরেছিল। তাতে কয়েকজন আহত হয়েছিলেন।
বেজমেন্টে ফাটল, তদন্তে কমিটি :ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় মার্কেটের বেজমেন্টে ফাটল দেখা দিয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এটি পরীক্ষা করানো হবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। এদিকে আগুনের ঘটনাটি তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মোজাম্মেল হককে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাতে পরিদর্শনের পর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রাজউক।
মেহবুবার চেনা মুখগুলো অচেনা হয়ে গেছে :গৃহিণী মেহবুবা হাসানের ইচ্ছা ছিল দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে স্বামীর অফিসে ইফতার করবেন। এজন্য দুই সন্তানকে স্বামীর সঙ্গে আগেই পাঠিয়ে দেন। অন্য স্বজনদের নিয়ে যখন তিনি উত্তরায় স্বামীর অফিসে যান, তখন সেখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। স্বামী আর দুই সন্তানের জন্য তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে থাকেন। পরে লোকজন যখন ভেতর থেকে তিনজনকে বের করে আনে, তখন চিরচেনা মুখগুলোকে যেন চিনতেই পারছিলেন না মেহবুবা। তার প্রিয়তম স্বামী মাহমুদুল হাসান, ১০ বছরের মেয়ে মাইশা আর মাত্র আট মাস বয়সী ছেলে মুত্তাকিন গুরুতর দগ্ধ হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান দগ্ধ শরীর নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। অন্যদিকে হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) আদরের দুুই সন্তান মুত্তাকিন ও মাইশার শরীরজুড়ে সাদা ব্যান্ডেজ। মেহবুবা একবার স্বামীর বিছানার পাশে যান, পরক্ষণে ফের ছুটে যান সন্তানদের কাছে। তার চোখ দিয়ে ঝরছিল পানি। বিলাপ করে তিনি বলছিলেন, ‘নিজেকেই আমার অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি কেন ওদের আগে পাঠালাম। এটা কী হয়ে গেল।’ স্বামী-সন্তানদের সুস্থতার জন্য প্রার্থনাও করছিলেন এই গৃহবধূ। তিনি বলছিলেন, তার জীবনের বিনিময়ে হলেও যেন আল্লাহ তার স্বামী আর সন্তানদের সুস্থ করে দেন।
মেহবুবা যখন বার্ন ইউনিটের দোতলায় ছটফট করছিলেন, নিচে তখন স্বজনদের কান্নার রোল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিয়মের কারণে তারা দগ্ধদের কাছে যেতে পারছিলেন না। প্রকৌশলী মাহমুদুলের বৃদ্ধ বাবা মোজাম্মেল হক মণ্ডল এ সময় বলেন, রমজান উপলক্ষে তিনি ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও বাবা-মার জন্য ঈদের কেনাকাটা করেছিল তার ছেলে। দু-একদিনের মধ্যেই সবাই মিলে গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় যাওয়ার কথা ছিল। তার পাশেই মাহমুদুলের মা গোলাপি বেগম দু’হাত তুলে সন্তান আর নাতি-নাতনির জন্য প্রার্থনা করছিলেন। একটু পর পরই অচেতন হয়ে পড়ছিলেন তিনি। দগ্ধ মাহমুদুল আর তার সন্তানদের সুস্থ হওয়ার বিষয়টি সময়ের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এখনই এ নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন।
Leave a Reply