প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাজীপুরের কাশিমপুর নারী কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত প্রায় ১০০ বছর বয়সী বৃদ্ধা অহিদুন্নেছা।
আজ মঙ্গলবার ওয়াহিদুন্নেছা নামের ওই নারী ছাড়া পান। ঘটনাটি মানবতার উজ্জ্বাল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা।
গত ২৬ জুন কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শন করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে নারী কারাগার পরিদর্শনের সময় অহিদুন্নেছার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় অহিদুন্নেছাকে জেল আপিলের মাধ্যমে রিভিউ আবেদন করতে বলেন প্রধান বিচারপতি। পরে সুপ্রিম কোর্টেল আপিল বিভাগে সাজার রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়।
অহিদুন্নেছার রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে গত সোমবার যাবজ্জীবন সাজার রায় বাতিল করে তাকে খালাসের রায় দেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ বেঞ্চ। সোমবার রাতেই অহিদুন্নেছার রায়ের অনুলিপিসহ মুক্তির কাগজপত্র কারাগারে এসে পৌঁছে। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপে প্রায় শতবর্ষী একজন বৃদ্ধার এ ধরণের কারামুক্তি দেশে আইনের শাসন ও মানবাধীকার প্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেছেন দেশে বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, আইন যে মানুষ ও মানবতার জন্য তা প্রমান করলেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
প্রায় ১০০ বছর বয়সী বৃদ্ধা অহিদুন্নেছার কারামুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ মানবতার বিষয়। ভিকটিম (বৃদ্ধা) অনেক দিন কারাভোগ করেছেন। আবার তার বয়সও প্রায় একশ’। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতি যা করেছেন তা দেশে মানবাধীকার প্রতিষ্ঠায় উদাহরণ হিসেবে থাকবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির প্রশংসা করে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সম্পূর্ণ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন শতবর্ষি বৃদ্ধাকে কারামুক্তি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। আমি মনে করি এটি শুধু বাংলাদেশেই না সারা পৃথিবীতেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এটা এক সময় এই ঘটনা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আইন যে মানুষের কল্যানে তৈরী করা হয়েছে তা প্রমান হল শতবর্ষি বৃদ্ধার কারামুক্তিতে। দীর্ঘদিন সাজা খেটে জেল আপিলের মাধ্যমে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। প্রধান বিচারপতির ওই বৃদ্ধাকে আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কারামুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। মানবতার এমন উদাহরণ আমাদের দেশে খুব কমই আছে। অনেকে হয়তো বৃদ্ধার দিকে খেয়ালই করতে না। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তা করেছেন। এই ঘটনায় সারা দেশের মানুষ খুশি হয়েছে। মানবতার এমন দৃষ্টান্ত যখন দেশের প্রধান বিচারপতি উপস্থাপন করেন তখন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সহজ হয়ে যায়।
কারুমুক্ত ওয়াহিদুন্নেছা চাঁদপুরের মতলব উপজেলার সালামত প্রধানিয়ার স্ত্রী।
একটি খুনের মামলায় ওই বৃদ্ধাকে ২০০০ সনের ১৪ মে চাঁদপুরের আদালত যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়। এরপর থেকে তিনি কুমিল্লা কারাগারে ছিলেন। পরে ২০০৭ সালের ২৩ নভেম্বর তাকে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
শতবর্ষী এই নারী ওই হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত স্বামী এবং যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত ছেলে ও পুত্রবধূসহ ২০ বছর কারাভোগ করেছেন। মামলার বিবরণে জানা গেছে, জমি সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা থাকা এবং শত্রুতার জেরে ১৯৯৭ সালের ২৯ জুন রাতে চাঁদপুরের মতলব থানার জোরাখালী গ্রামের হযরত আলীসহ পরিবারের আট সদস্যকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মতলব থানার হত্যা মামলায় ওই বছরই গ্রেফতার হন অহিদুন্নেছা। এরপর থেকেই তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। চাঞ্চল্যকর ওই হত্যা মামলায় ২০০০ সালের ১৪ মে চাঁদপুরের জেলা ও দায়রা জজ ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং অহিদুন্নেছাসহ ৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন। বিচার চলাকালে মারা যান দুই আসামি। দ-প্রাপ্তরা আপিল করেন। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি নিয়ে ২০০৪ সালের ৬ এপ্রিল রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত সফিকুল ইসলাম মন্টু ও ছালামত প্রধানিয়ার সাজা বহাল রাখা হয়। ছালামত প্রধানিয়া অহিদুন্নেছার স্বামী। খালাস পান নয় আসামি। যাবজ্জীবন সাজা বহাল থাকে আলী হোসেন, অহিদুন্নেছা ও ভানু আক্তারের। যাবজ্জীবন সাজা বহালের রায়ের বিরুদ্ধে ৪৭০ দিন পর লিভ টু আপিল করেন অহিদুন্নেছা। ২০০৭ সালের ১২ আগস্ট ওই আপিল খারিজ করে দেন তৎকালীন আপিল বিভাগ। তাকে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করতে হয়।
গত ২৬ জুন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার পরিদর্শনে যান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরিদর্শনকালে কারাগারে অহিদুন্নেছাকে দেখতে পান তিনি। পরে শতবর্ষী অহিদুন্নেছার ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নেন প্রধান বিচারপতি। এরপরই প্রধান বিচারপতি যাবজ্জীবন সাজার রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দাখিলের জন্য কারা কর্তৃপকে নির্দেশ দেন।
২৯ জুন রিভিউ আবেদনের চিঠিতে অহিদুন্নেছা লিখেছেন, ‘বর্তমানে ১০০ বছরের বৃদ্ধা আমি। আমার স্বামী, পুত্র, পুত্রবধূসহ পরিবারের ১১ জন সদস্য ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে’ একটি হত্যা মামলার দ-প্রাপ্ত আসামি। আমার পরিবারের সকল পুরুষ সদস্য জেলে থাকায় সময়মতো আইনজীবী নিয়োগ করতে না পারায় আমার লিভ টু আপিল খারিজ হয়ে যায়। আমি এখন চোখে কম দেখি। কারো সাহায্য ছাড়া চলতে পারি না। আমার পুত্রবধূ কারাগারে আমার দেখভাল করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে আমি আপিল বিভাগের যাবজ্জীবন সাজা বহালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন করতে চাই।’
এরপরই কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা অহিদুন্নেছার রিভিউ আবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। আপিল বিভাগের গত সোমবারের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য আসে। রাষ্ট্রপে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
শুনানি শেষে আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজার রায় বাতিল করে তাকে অবিলম্বে কারামুক্তির নির্দেশ দেন বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। মুক্তির পর অহিদুন্নেছা শুকরিয়া আদায় এবং প্রধান বিচারপতিসহ তার মুক্তির পেছনে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের জন্য দোয়া করেন বলে জানিয়েছেন কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা।
Leave a Reply