ডেইলি চিরন্তন:‘‘মন খারাপ।’’
‘‘মন কেমন।’’
‘‘কান্না পাচ্ছে তো!’’
‘‘পাপ্পু দাদা, সৃজিত আঙ্কেল, সুব্রত আঙ্কেলকে মিস করছি। আর মাকেও।’’ মাকে মিস করছিস মানে? মা তো পাশেই বসে রয়েছেন। ‘‘না! আমার সিরিয়ালের মা। আমি তো সিরিয়ালের মাকেও ‘মা’ বলেই ডাকি। জানো, মা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।’’ বলে উঠল একরত্তি আরশিয়া মুখোপাধ্যায়। না! ভুল হল। ভুতু। গত এক বছরে ওর আরশিয়া নামটা যেন ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। টেলি দর্শকদের কাছে ও আদরের ভুতু। সেই ছোট্ট ভূতের জার্নি এ বার শেষের মুখে। আরশিয়া আবার ফিরছে চেনা রুটিনে। পুলকারে করে স্কুলে যাওয়া। ক্লাসরুম। বন্ধু। শুটিং ফ্লোর আপাতত ফেড আউট হয়ে যাচ্ছে। কারণ প্রচুর অফারের হাতছানি থাকলেও এই মুহূর্তে আবার ক্যামেরার সামনে মেয়েকে নিয়ে না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আরশিয়ার মা ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়। আপাতত ফোকাসে পড়াশোনা।
কেন এই সিদ্ধান্ত? ভাস্বতী বললেন, ‘‘অফার এসেছে অনেক। কিন্তু এত বড় একটা প্রজেক্টের পর মানসিক প্রস্তুতি, শারীরিক বিশ্রাম দরকার। সাহানাদি (চিত্রনাট্যকার সাহানা দত্ত) বিশাল সুযোগ দিয়েছিলেন। এই সিরিয়ালের গল্পটা আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে একেবারে আলাদা। তাই খুব ভাল অফার না এলে আপাতত কিছু ভাবব না। আসলে ভুতুর ইমেজটা এখনই হয়তো ভাঙতে চাইছি না আমরা। কিন্তু এর পুরোটা আমাদের ওপরও নির্ভর করছে না। জলের স্রোত কোন দিকে বইবে সেটা দেখা যাক।’’
ইন্ডাস্ট্রির নিয়মে সব সিরিয়ালই এক দিন শেষ হয়। কিন্তু এমন মনখারাপিয়া ঘোর বোধহয় থাকে না স্টুডিও জুড়ে। ভারতলক্ষ্মীর ফ্লোর জুড়ে এত দিন ছিল ভুতুর আনাগোনা। প্রতি দিন গিয়ে পছন্দ মতো একটা করে বড় চিপসের প্যাকেট ভুতু তুলে নিত ‘চিপস কাকু’ জ্যোতিবাবুর গোডাউন থেকে। নবীনার মালিক জ্যোতিবাবু ভুতু শেষ হয়ে যাওয়ায় এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করছেন। ভুতুর সঞ্জুদা। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতেন। আর তার উত্তরে ভুতু ঝগড়া করত, সেটা উনি এনজয় করতেন। শেষ দিন এসে যখন ওকে কোলে নিয়েছেন তখন দু’চোখে জল। ভুতু মেকআপ করতে ভালবাসে বলে শেষ দিন মেকআপ হেড সুব্রত বণিক একটা গোটা মেকআপ কিট গিফট করেছেন ওকে।
আবার ‘পাপ্পু দাদা চলো সাইকেল চালাব’ ভুতুর বলার অপেক্ষা। অমনি মেকআপ অ্যাসিস্ট্যান্ট পাপ্পু দাদা সাইকেল চালাতে চলল। ঘুম পেয়েছে ভুতুর। কোলে করে সেটে ঘুরে বেড়াত পাপ্পু দাদাই। ‘‘জানো, আমাদের মেকআপ ম্যান পাপ্পুদাদার সঙ্গে লুকোচুরি খেলি, কুমির ডাঙা খেলি। আমিই বারবার মানুষ হই। আর পাপ্পু দা কুমির’’ গল্প শোনাচ্ছিল আরশিয়া। শেষ দিনের শুটিংয়ে যেন লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলেন পাপ্পু। আর ছিলেন পরিচালক সৃজিতদা। যাঁর কোল থেকে নামতই না ভুতু। শুধু ক্যামেরার সামনের সময়টুকু বাদ দিয়ে পরিচালকের কোলেই বসে থাকত এই খুদে সেলেব। শেষ দৃশ্যটা শুট করার পর চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি সৃজিতও।
ভাস্বতী বলছিলেন, ‘‘শেষ দিন সেটের সকলে কেঁদে ফেলেছে। মন ছুঁয়ে যাওয়া শেষ। ওটা দেখে চোখে জল আসবে না, এমন হতে পারে না। আমি দর্শকদের বলব, আপনারা দেখুন। খুব ভাল লাগবে। সিনটা করতে গিয়ে সকলে কেঁদে ফেলেছিলেন সেটে। শুধু শুটিং শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে না। সিনটার জন্য কেঁদে ফেলেছিলেন।’’ আর ভুতু? কেঁদেছিলি বুঝি? ‘‘সবাই কাঁদল, আমি কেন কাঁদব না বলো?’’ বেশ গম্ভীর হয়ে জবাব দিল আরশিয়া।
সিরিয়াল শেষ হলেই সাধারণত ধীরে ধীরে দর্শকদের মন থেকে সরে যান অভিনেতারা। কালের নিয়মে অন্য কেউ শূন্যস্থান পূরণ করে দেন। ভুতুকে কি মনে রাখবেন দর্শক? ভাস্বতীর কথায়, ‘‘আমার তো মনে হয় সকলে মনে রাখবে ওকে। তবে সেটা সময় বলবে।’’ পাশ থেকে ভুতুর সংযোজন, ‘‘আমার তো মনে হয় কেউ মনে রাখবে না। কারণ পর পর সিরিয়াল আসবে। আর আমাকে ভুলে যাবে। তবে আমি কী করে জানব বলো, অন্যদের মনের কথা?’’
আগামী সোমবার থেকে রাত ন’টায় ওই নির্দিষ্ট চ্যানেলে শুরু হচ্ছে একটি নতুন ধারাবাহিক। ‘‘আমি ন’টা বাজলে সোমবার থেকে আর টিভি চালাব না। ভুতুর জায়গায় কাউকে বসাতেই পারব না’’ বললেন আরশিয়ার ঠাকুমা পূর্ণিমা মুখোপাধ্যায়। কিন্তু এত জনপ্রিয় ধারাবাহিক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন? টিআরপি-র জটিল হিসেব? না! চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি। তবে আরশিয়ার মা বললেন, ‘‘টিআরপি কমে গিয়েছে কিনা জানি না। হয়তো এই ইমেজটা প্রিজার্ভ করলেন ওঁরা।’’
বড় হয়ে চিকিত্সক হতে চায় ছোট্ট আরশিয়া। গত এক বছরে শুটিং আর পড়াশোনা দারুণ ব্যালান্স করে চলেছে। ওর জন্য আলাদা ঘর ছিল। ও ঘুমতো। ওর বইখাতা, পেন্সিল বক্স সব রাখা থাকত সেখানেই। ভাস্বতী শেয়ার করলেন, ‘‘দু-তিনটে সিনের গ্যাপ থাকলে পড়িয়ে নিতাম। হাউজ খুব হেল্প করেছে। তাই পড়াশোনার খুব একটা ক্ষতি হয়নি। স্কুলে হয়তো রোজ যেতে পারত না। ছুটি পেলে আমি ভাবতাম একটু রেস্ট নিক। স্কুলও খুব সাপোর্ট করেছে।’’
দীর্ঘ জার্নিতে অনেক ভালবাসা পেয়েছে এই খুদে ভূত। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আসা এক মহিলার কথা ভুলতে পারবে না মুখোপাধ্যায় পরিবার। ভাস্বতী জানালেন, বাংলাদেশ থেকে এক মহিলা এসেছিলেন ওপেন হার্ট সার্জারি করাতে কলকাতায়। ভর্তি হওয়ার আগের দিন ফ্লোরে এসে ভুতুকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি আমারে একটু আশীর্বাদ কইরা দাও। আমি যেন বাঁইচ্যা ফিরা আইসি।’’ এমন ভাবেই দেশে, বিদেশে অসংখ্য মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল আরশিয়া।
সিরিয়াল শেষ। কিন্তু একটা ইচ্ছে আজও অপূর্ণ থাকল আরশিয়ার। খুব চিন্তিত মুখে সে বলল, ‘‘আমি ভূতে ভয় পাই। কিন্তু ভূতকে দেখার খুব ইচ্ছে। আমাকে তো ভূত দেখাই দেয় না।’’
Leave a Reply