লেবাননে নেয়ার কথা বলে বাংলাদেশি ৩৫ নারীকে পাচার করা হয়েছে সিরিয়ায়। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে লেবাননের সহযোগিতা চেয়েছে ঢাকা। ইতিমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লেবাননস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসকে চিঠি দিয়েছে। আর দূতাবাস লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটি ও শ্রম মন্ত্রণালয়কে বিস্তারিত জানিয়েছে পত্রের মাধ্যমে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।চার মাস আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠির উত্তর দিয়েছে লেবাননস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস।
মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠির উত্তর দিয়েছে লেবাননস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। গত ২রা মার্চ পাঠানো চিঠিতে পাচার হওয়া ৩৫ নারীর বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। দূতাবাসের প্রথম সচিব সায়েম আহমেদ স্বাক্ষরিত এ চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, র্যব-৩ পরিচালক ও জর্ডানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসকে। চিঠিতে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পত্র নং-সি অ্যান্ড ডব্লিউ/কল্যাণ/জর্ডান(সিরিয়া)/৭৬/৫২৬-এর মাধ্যমে সিরিয়ায় পাচার হওয়া ৩৫ নারীকে দেশে পাঠাতে সাহায্য চাওয়া হয়। দূতাবাস বিস্তারিত জেনে লেবানন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সিরিয়ায় পাচারকৃত বাংলাদেশি নারী কর্মীদের কয়েকজন জানান, লেবানন বা অন্য কোনো দেশে আনার নাম করে তাদের সরাসরি সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশি দালালচক্র সরাসরি সম্পৃক্ত। এছাড়া চিঠিতে লেবাননস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস লিখেছে, সিরিয়ার বিষয়ে সমবর্তী দায়িত্বপ্রাপ্ত লেবাননের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। এ অবস্থায় পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ দূতাবাস আম্মানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া হয়। চিঠিতে জানানো হয়, ৩৫ জনের একজন কমেলা বেগম সিরিয়ায় নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে গেছে। পরে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে। এছাড়া বিএ০৬৮১৩৪৩ পাসপোর্টধারী আলাপী বেগমও নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরেন। পরে তিনিও ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। পাচার হওয়া নাজমা বেগমের পাসপোর্ট নাম্বার-এবি০১৩০৬৫৮। নাজমাকে সিরিয়া পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাংলাদেশ এক্সপোর্ট করপোরেশন ও লেবাননের লিস্ট এজেন্সি জড়িত। এক্ষেত্রে লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটি ও মিনিস্ট্রি অব লেবারকে ওই এজেন্সির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া দূতাবাস এ বিষয়ে লেবাননের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। পাচার হওয়া আরেক নারী রহিমা বেগম। তার পাসপোর্ট নং-এজি৭৩৭৫৩০৩। চিঠিতে বলা হয়েছে, দূতাবাস থেকে রহিমা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তাকে লেবানন পাঠানোর কথা থাকলেও বাংলাদেশের আফজাল নামের একজন দালাল তাকে সরাসরি সিরিয়ায় পাঠান। তিনি দেশে ফেরত যেতে চান। তাকে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। মোছা. শাহনাজ আক্তার নামে আরেক নারীর লেবাননের মনি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে লেবাননে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাকে সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার পাসপোর্ট নং-বিএ০০৩১৮৭৯। চিঠিতে শাহনাজের ব্যাপারে বলা হয়, লেবাননের মনি এজেন্সির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ফোন করে দূতাবাসে আনা হয়। তাদের কাছে তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। এর উত্তরে তারা গত ডিসেম্বরের মধ্যে শাহনাজের ব্যাপারে বিস্তারিত জানাবেন বলে অবহিত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আর দূতাবাসে যোগাযোগ করেনি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লেবাননের মিনিস্ট্রি অব লেবারকে অনুরোধ জানানো হয়। পরে দূতাবাসের নিজস্ব সূত্রের তথ্য অনুসারে জানা যায়, সামপ্রতিককালে মনি এজেন্সি নাম পরিবর্তন করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শুধু শাহনাজ নয়, এফ৫৮৩৭৬৩১ পাসপোর্টধারী রোকেয়া বেগম, এই৬১৬১৫৩৪ পাসপোর্টধারী আছিয়া বেগমও মনি এজেন্সির মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হন। পাচারের কবলে পড়েন। বাংলাদেশি এজেন্সি সব জেনে-শুনেই তাদের পাঠায়। তাদের ব্যাপারেও মনি এজেন্সির একই বক্তব্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আর দূতাবাসে যোগাযোগ রক্ষা করেনি। এডি৫৬৪৩৭৫৭ পাসপোর্টধারী মাহফুজার সিরিয়ায় পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাংলাদেশ এক্সপোর্ট করপোরেশন ও লেবাননের বেস্ট সার্ভিস নামের এজেন্সি জড়িত। বেস্ট সার্ভিস এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটি এবং শ্রম মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। জেনারেল সিকিউরিটি জানিয়েছে, বর্তমানে বেস্ট সার্ভিস এজেন্সির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দূতাবাস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএ০০০৪২৯৫ পাসপোর্টধারী আলোর বেগম বাংলাদেশি দালাল সিরাজের মাধ্যমে লেবাননে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাকে লেবানন না পাঠিয়ে সিরিয়ায় পাঠানো হয়। আলো বেগমের সিরিয়া পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশের হাসান এন্টারপ্রাইজ এবং লেবাননের এমরো এজেন্সি জড়িত। এ ব্যাপারে লেবাননের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এফ০৫৮৯৯৫১ পাসপোর্টধারী রাবেয়া বেগম, বিএ০১৪৩৫২৩ পাসপোর্টধারী জাহিনা খাতুন পাচারের সঙ্গেও হাসান এন্টারপ্রাইজ ও এমরো এজেন্সি জড়িত। বিএ০৭০০৬১৯ পাসপোর্টধারী রাশেদা বেগম সম্পর্কে বলা হয়, লেবাননের ফ্রেন্ডস এজেন্সি রাশেদাকে পাচার করে। কিন্তু ফ্রেন্ডস এজেন্সির দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাশেদা লেবাননে আসেনি। আর লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটির তথ্য অনুসারে রাশেদার নামে কোনো ভিসা লেবানন ইস্যু করেনি। একই ঘটনা কহিনুরের ক্ষেত্রেও। তার পাসপোর্ট নাম্বার বি০২০৯৯৯১। একই ঘটনার শিকার মোছা. ছুপিয়া বেগম। তার পাসপোর্ট নাম্বার বিএ০৭৫২৬৯৯। এ তিনজনই ফ্রেন্ডস এজেন্সির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। বিএ০৯৪১২৪৯ পাসপোর্টধারী নুরুন্নাহারের সন্ধান পাওয়া যায়নি। লেবাননের যে বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়ার কথা ছিল সে বাসায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নুরুন্নাহারকে যে এজেন্সি লেবাননে পাঠানোর কথা সেই এজেন্সি তাকে লেবানন পাঠায়নি। এছাড়া বিএ০৮৮২৯২৪ পাসপোর্টধারী জহুরা বেগমের কোনো তথ্য উদঘাটন সম্ভব হয়নি বলে চিঠিতে জানানো হয়। এএফ২৮৩১৬৬৯ পাসপোর্টধারী নাজমাকে বাংলাদেশি দালাল সিরাজ ও বাচ্চু সিরিয়ায় পাচার করে। ওদিকে বিএ০২৫৪৯০৯ পাসপোর্টধারী সেলিনা বেগমের কোনো তথ্যও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এজি০০৬৫১৭৫ পাসপোর্টধারী জাহানারা বেগমকে পাচারের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের আল হাসিব ও লেবাননের আল ইমতিয়াজ এজেন্সি। দূতাবাসের নিজস্ব সূত্রের তথ্য অনুযায়ী সম্প্রতি আল ইমতিয়াজ এজেন্সির নাম পরিবর্তন হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লেবাননের শ্রম মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিএ০৪৩১০১০ পাসপোর্টধারী ফাতেমা বেগম, এডি৫৭২৫৩৯৮ পাসপোর্টধারী আঙ্গুরা খাতুন, বিবি০১১৫৯৬৪ পাসপোর্টধারী মাকসুদা বেগম, এজি০৫৮২৫৫৫ পাসপোর্টধারী মর্জিনা, বিএ০৩৫৯৮৯৬ পাসপোর্টধারী সাজেদা বেগম, বিবি০৫৪২২৫৬ পাসপোর্টধারী জাহানারা বেগম, এই৭২৬৫৭৯২ পাসপোর্টধারী ছাবেরা বেগম, বিবি০৭৪০৬৪৮ পাসপোর্টধারী বিউটি খাতুন, এই৯৮৮৬৬৭০ পাসপোর্টধারী মিনা বেগম, বিএ০৫৬৫৩১১ পাসপোর্টধারী ফাহিমা বেগম, এএফ১৫১৮৫৯৪ পাসপোর্টধারী মিনারা, বিবি০২৫৫৬৯৪ পাসপোর্টধারী মনি বেগম, বিএ০১০৩১৯৭ পাসপোর্টধারী ফাতেমা খাতুন এবং বিএ০৬৭৯৯১৪ পাসপোর্টধারী মোছা. হাছানা বেগমও আল হাসিব ও আল ইমতিয়াজ এজেন্সির প্রতারণার শিকার। প্রতিটি ঘটনায়ই লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটি ও মিনিস্ট্রি অব লেবারে পত্র দেয়া হয়েছে দূতাবাসের পক্ষ থেকে। এছাড়া এএফ৪৪৩৩৮৮৭ পাসপোর্টধারী সেলিনা বেগম লেবাননের আল আমল এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যায়। এ বিষয়ে জানতে তাদের দূতাবাসে তলব করা হয়। তারা জানিয়েছে, সেলিনা বেগম অনেক আগেই গৃহকর্তার অনুমতি না নিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এ ব্যাপারে তারা লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটিতে অভিযোগ করেছে। দূতাবাসের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, সমপ্রতি আল আমল এজেন্সির নাম পরিবর্তন হয়েছে। এ এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লেবানন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
Leave a Reply