‘মাহমুদা খানম মিতু এবং এসআই আকরাম হোসেন হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। দু’জনই পরকীয়ার জেরে খুন হয়েছেন। দুটি হত্যা একই উদ্দেশ্যে সংঘটিত। আকরামের স্ত্রী বনানী বিনতে বশির বর্ণির সঙ্গে বাবুল আক্তারের পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। বর্ণিকে কাছে পেতে আগে আমার ভাইকে (আকরাম) পরে মিতুকে হত্যা করা হয়। এ কারণেই মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাতে আকরাম হত্যার বিষয়টিও তদন্ত করেন, এজন্য আমি চট্টগ্রামে এসেছি। মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ দিয়েছি, আকরাম সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়নি, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার কারণ হিসেবে বেশ কিছু তথ্য তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছি।’
বুধবার মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপির (গোয়েন্দা শাখা) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. কামরুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন ঝিনাইদহে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এসআই আকরামের বড় বোন জান্নাত আরা পারভীন রিনি।
সকাল সাড়ে ১০টায় ভাগ্নি মুর্শিদা জাহান ডলিকে সঙ্গে নিয়ে সিএমপিতে আসেন রিনি। বেলা সাড়ে ১২টায় মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামানের ২০৯ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। দীর্ঘ আলাপ শেষে বেলা ২টার দিকে তারা তদন্ত কর্মকর্তার কক্ষ থেকে বের হন।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আকরামের স্ত্রী বর্ণিসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
আকরামের ভাগ্নি মুরশিদা জাহান ডলি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বর্ণি এবং বাবুল আক্তার একে অপরকে পাওয়ার জন্য প্রথমে এসআই আকরামকে পরে মিতুকে খুন করা হয়। যখন মিতুকে হত্যা করা হল, তখন তার ছেলে অক্ষত ছিল। যদি কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী এ কাজ করত তাহলে ওই সময় তার ছেলেকেও আক্রমণ করত। কিন্তু করেনি। এতে বোঝা যায়, বাবুল আক্তারের পরকীয়ার জেরে মিতুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বাবুল আক্তার যখন মিশনে ছিলেন তখন ৩ মাস পর পর দেশে এসে ২০ দিন করে থেকে গেছেন। ওই সময় বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে স্ত্রীর সঙ্গে কিংবা শ্বশুরের বাসায় যাননি। ছিলেন বর্ণির সঙ্গে মাগুরার বাসায়। বাবুল আক্তারের পাসপোর্ট দেখলে ওই সময় দেশে আসার বিষয়টি জানতে পারবেন। তদন্ত কর্মকর্তার কাছেও আমার এসব বিষয় তুলে ধরেছি। আকরাম হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের আশায় আমরা এখানে এসেছি।
এ প্রসঙ্গে বাবুল আক্তারের শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘রিনি তার ভাই হত্যার বিচার চাইতে চট্টগ্রামে গেছে। আমিও আইওকে বলেছি, এসআই আকরাম হত্যা নিয়ে বাবুল আক্তার এবং বর্ণিসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। তখন বোঝা যাবে সমস্যা কোথায়? রিনি যেখানে বলেছে, আকরামের স্ত্রী খুনি। আর একজন খুনিকে কীভাবে দুই বছর ধরে বাবুল আক্তারের পরিবার আশ্রয় দেয়। এ প্রশ্নের উত্তর তাদের দিতে হবে। বাবুল আক্তারের ভাই বর্ণির পক্ষ নিয়ে পত্রিকায় উকিল নোটিশ পাঠাচ্ছে। বর্ণির সংবাদ সম্মেলনে বাবুল আক্তারের বাবা বসা থাকে। কিন্তু ছেলের বউকে মেরে ফেলা হল, এজন্য বাবুল আক্তার বলেন, তার ভাই, বাবা কেউ কথা বলছে না। অভিনয় অনেক হয়েছে। আমরা এসব অভিনয় আর দেখতে চাই না। মিতু হত্যার আসল মোটিভ জানতে চাই। বাবুল আক্তার জঙ্গি-ফঙ্গি নাটক সাজিয়ে ৬ মাস আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছিল।’
আকরামের বোন রিনি বলেন, গত দুই বছর ধরে বর্ণি বাবুল আক্তারের মাগুরার বাসায় রয়েছে। ২০০৭ সালে এসআই আকরামের একটি মেয়ে সন্তান হয়। যার নাম রাখা হয় আফরিন। ওই সময় সিজার অবস্থায় আকরামের স্ত্রী বর্ণি ৫ দিন হাসপাতালে ছিলেন। ওই সময় আমিও ছিলাম। বাবুল আক্তারের ভাই সাবু ও বোন লাবণী বর্ণিকে দেখাশোনা করেন। তখন প্রথমবারের মতো আকরামের মুখ থেকে শুনলাম, বাবুল আক্তারের সঙ্গে বর্ণির পরকীয়া সম্পর্কের কথা।
আকরাম জানিয়েছে, বাবুল আক্তারের কারণে তার সংসারে অনেক অশান্তি হচ্ছে। বাবুল আক্তারের বিষয়ে ঝামেলার জেরে বর্ণি আকরাম খুনের এক মাস আগে ঝিনাইদহে বাবার বাসায় ওঠে।
পরে আকরামকে পরিকল্পিতভাবে বলে, আমরা ঝামেলা মিটিয়ে ফেলব, তুমি নিত আস। যমুনা সেতু হয়ে যখন যাচ্ছিল তখন তাকে মারা হয়। আকরামকে যেখানে মারা হয়, শৈলকূপায় ছিল বাবুল আক্তারের গ্রামের বাড়ি। এখন বর্ণি বলছে, বাবুল আক্তারকে চিনে না, তার পরিবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
অথচ ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বর্ণি যখন সংবাদ সম্মেলন করে, তখন বাবুল আক্তারের বাবা তার পাশে বসা ছিল। অথচ দুই পরিবার বাবুল আক্তার এবং বর্ণি বারবার বলে আসছে, কেউ কাউকে চিনে না। এ মিথ্যাচার কেন? বাবুল আক্তার বলেছে যাকে চিনে না, জানে না, তার সঙ্গে পরকীয়া হয় কীভাবে। এখন বর্ণিকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে বাবুল আক্তারের ভাই। এবার বর্ণি যখন সংবাদ সম্মেলন করল তখনও দেখলাম বাবুল আক্তারের বাবা তার পাশে বসা আছে। রিনি আরও বলেন, ২০০১ সালে পুলিশের এসআই পদে আকরাম হোসেনের চাকরি হয়। ২০০৬ সালের ১৩ জানুয়ারি আকরামের সঙ্গে বনানী বিনতে বশির বর্ণির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের দেড় বছর পর ঢাকার পিজি হাসপাতালে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।
২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর এসআই আকরাম হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়। ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার ময়নাতদন্ত করার কথা বললেও বর্ণি ময়নাতদন্ত করতে দেয়নি। পরদিন ১৪ জানুয়ারি আকরামের লাশ দাফন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হলে বর্ণির বাবা জানাজায় না গিয়ে বর্ণিকে নিয়ে বাবুল আক্তারের মাগুরার বাসায় পালিয়ে যান। সেখানে দুই বছর ধরে বসবাস করছেন।
এ প্রসঙ্গে মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. কামরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘নিহত এসআই আকরামের বোন রিনি আমার সঙ্গে দেখা করে কিছু তথ্য দিয়ে গেছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। মিতু হত্যার সঙ্গে ওই ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে এসআই আকরামের স্ত্রী বর্ণিসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
Leave a Reply