সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে মোটরযান চালকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি করতে বিশিষ্টজনদের দাবি থাকলেও তা অষ্টম শ্রেণি রেখেই ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৭’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তবে প্রস্তাবিত আইনে গাড়ি চালানোর সময় চালকদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এই খসড়া আইনটি অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
নতুন এই খসড়া আইনে নতুন ব্যবস্থা হিসেবে চালকদের পয়েন্ট নির্ধারণ করে দিয়ে অনিয়মের জন্য তা কাটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও আইন অনুযায়ী ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালালেও শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তা ছাড়াও বাড়ছে পরিবহন ক্ষেত্রের নানা অপরাধের শাস্তি।
এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বলেন, ‘দি মটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ আছে। এটা যেহেতু অর্ডিন্যান্স ও মার্শাল ল আমলের করা সেজন্য আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নতুনভাবে আইনে পরিণত করার বাধ্যবাধকতা আছে। সেজন্য এটি নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে বেশ বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘পরিবহন সেক্টরটা অনেক ভাইব্র্যান্ট, অনেকগুলো এজেন্সি কাজ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের অনেক লিঙ্ক রাখতে হয়। আমাদের রিজিওনাল কানেকটিভিটি, আন্তর্জাতিক অনেক বিষয় এর মধ্যে চলে আসে। শাস্তির মধ্যে পরিবর্তন আনা হয়েছে ও সময়ের ধারাবাহিকতায় যে পরিবর্তন হয়েছে সে জিনিসগুলো আইনে নিয়ে আনা হয়েছে। ’
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘গাড়ি চালকের বয়সসীমা আগে ছিল কমপক্ষে ১৮ বছর, পেশাদার হলে কমপক্ষে ২১ বছর বয়স হতে হবে। নতুন আইনে এ বিষয়টি আগের মতোই রয়েছে। ’
আগে গাড়ি চালকদের লেখাপড়ার বিষয়ে কিছু ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন আইনে এ বিষয়টি নিয়ে আসা হয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে। কন্ডাক্টর বা চালকের সহযোগীকে কমপক্ষে লেখার ও পড়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তার লেখাপড়া থাকতে হবে। ’
গাড়ি চালনার সময় মোবাইল ব্যবহারের বিষয়টি তো আগে ছিল না জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘বিষয়টি নতুনভাবে আইনের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। গাড়ি চালানোর সময় কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না। গাড়ি চালনার সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড পেতে হবে। ’
খসড়া আইন অনুযায়ী, সড়কের ফুটপাতের উপর দিয়ে কোন ধরনের মোটরযান চলাচল করতে পারবে না। যদি করে তবে তিন মাসের কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা গুণতে হবে বলেও জানান তিনি।
পরিবহন শ্রমিকরা যেভাবে চেয়েছেন আইনটি সেভাবে করা হয়েছে- এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আইনটি প্রণয়নে যথেষ্ট পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের ক্ষেত্রে যে বিধানগুলো দরকার সবগুলো আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ’
শফিউল আলম বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, ছয় মাস বা এর বেশি কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা বা এর বেশি জরিমানার অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় আসামি গ্রেপ্তার করতে পারবে। অন্য কোনো ক্ষেত্রে তা পারবে না। ’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালায় তবে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। কেউ এই অপরাধ করলে তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে। আগে এক্ষেত্রে ৩ মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা ছিল। ’
চালকের সহকারির লাইসেন্স লাগবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘কন্ডাক্টারের লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। ’
তিনি বলেন, ‘জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করলে আগে শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা। প্রস্তাবিত আইনে মূল শাস্তি কারাদণ্ড আগের মতোই আছে, জরিমানা ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। ’
ফিটনেস না থাকা মটরযান চালালে আগে শাস্তি সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা ছিল জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘সেখানে এখন শাস্তি সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা। এ শাস্তি পাবে মূলত গাড়ির মালিক। ’
দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দণ্ডবিধিতে যে শাস্তি রয়েছে সেই শাস্তি প্রযোজ্য হবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘দণ্ড বিধিতে তিন রকমের বিধান রয়েছে। (দুর্ঘটনা) যদি (ইচ্ছাকৃতভাবে) নরহত্যা হয়, তবে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা হবে। এটার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। (দুর্ঘটনায়) হত্যা না হলে, ক্ষেত্রে ৩০৪ ধারা প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে শাস্তি যাবজ্জীবন। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা হলে ৩০৪ এর (বি) অনুযায়ী ৩ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। নতুন আইনে শুধু পরিবহন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দণ্ডগুলো আনা হয়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘গাড়ি ওজনসীমা অতিক্রম করলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানা। এখানে মালিক ও ড্রাইভার দুই গ্রুপকেই যুক্ত করা হয়েছে, তারা দায়ী হবে। ’
এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে মানুষ আহত বা নিহত হলে তা দণ্ডবিধিতে চলে গেছে। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, দুই গাড়িতে পাল্লা দেওয়ার কারণে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হবে। বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং এতে দুর্ঘটনা না ঘটলেও ২ বছরের কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। ’
একই সঙ্গে মোটরসাইকেলে চালক ছাড়া একজনের বেশি যাত্রী বহন, মোটরসাইকেলের চালক ও যাত্রীর হেলমেট ব্যবহার না করা, চলন্ত অবস্থায় চালক বা কন্ডাক্টার কোন যাত্রীকে গাড়িতে ওঠাতে বা নামাতে পারবেন না, প্রতিবন্ধীদের জন্য অনুকূল সুযোগ সুবিধা না রাখা, ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়িতে কোন যাত্রী বা পণ্য বহন করা যাবে না, কোন সড়ক বা মহাসড়কে গাড়ি মেরামতের জন্য যন্ত্রাংশ ও মালামাল রেখে যানবাহন বা পথচারী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলেও একই শাস্তি পেতে হবে।
অনিয়মে পয়েন্ট কাটা যাবে চালকদের- এ বিষয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশে গাড়ি চালকদের অপরাধের জন্য পয়েন্ট কাটার ব্যবস্থা আছে। নতুন আইনেও সেই পদ্ধতিটি প্রস্তাব করা হয়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘ড্রাইভিং সংক্রান্ত বিধি-বিধান অমান্য করলে আস্তে আস্তে চালকদের পয়েন্ট কমতে থাকবে। ১২টি পয়েন্ট দেওয়া থাকবে, দোষের কারণে পয়েন্ট কর্তন হতে থাকবে। কোন অপরাধ করলে কত পয়েন্ট কাটা যাবে তাও আইনে বলা হয়েছে। পয়েন্ট জিরো হয়ে গেলে তার আর লাইসেন্স থাকবে না। ’
এদিকে নতুন এই আইনে দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষেত্রে চালকদের কোন শাস্তি নির্ধারণ করা হয়নি। এক্ষেত্রে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারণের কথা খসড়া আইনে বলা হয়েছে।
Leave a Reply