আলোচিত রাডার ক্রয় দুর্নীতির মামলায় খালাস পেয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদসহ ৩ জন। দুই যুগেরও বেশি সময় আগে দায়ের করা ওই মামলার রায় গতকাল ঘোষণা করেন ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতের বিচারক কামরুল হোসেন মোল্লা। এ মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণে আসামিদের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এরশাদ ছাড়াও বিমানবাহিনীর সাবেক দুই প্রধান মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও সুলতান মাহমুদকে বেকসুর খালাস দেন বিচারক। গতকাল রায়ের সময় এরশাদ ও অন্য দুই জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মামলার অন্য দুই আসামি ইউনাইটেড ট্রেডার্সের পরিচালক এ কে এম মুসা বিচার চলাকালে পলাতক থাকা অবস্থায় মারা যান। এ ছাড়া ইউনাইটেড ট্রেডার্সের পরিচালক শাহজাদ আলীকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯২ সালে তার বিরুদ্ধে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো (বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন) এ মামলায় দায়ের করে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নিম্নমানের রাডার ক্রয় করে দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ৬৪ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯১৮ টাকার ক্ষতি করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ গতকাল রায় শোনার জন্য বেলা সোয়া তিনটার দিকে আদালত প্রাঙ্গণে আসেন। এ সময় তার দলের নেতাকর্মীরা এরশাদ ও জাতীয় পার্টির নামে স্লোগান দেন। এর কিছুক্ষন পরে এরশাদ মহানগর দায়রা জজ আদালতের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত সংশ্লিষ্ট আদালতের এজলাসে আসেন। কালো সাফারি পরা এরশাদকে এজলাসের বামদিকে রাখা একটি চেয়ারে বসতে দেয়া হয়। তবে, রায় ঘোষণার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এবং আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগের সময় দৃশ্যত তিনি ছিলেন নির্বিকার। রায়ের আগে পরে তিনি কারো সঙ্গে তেমন কোনো কথা বলেননি। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কাজী ফিরোজ রশীদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা, রুহুল আমিন হাওলাদার, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ কেন্দ্রীয় নেতারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। পৌনে চারটার দিকে আদালতের বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। প্রথমে তিনি এ মামলার সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনান। পর্যবেক্ষণে আদালতের বিচারক বলেন, কোন আসামি কীভাবে এই রাষ্ট্রীয় টাকা আত্মসাৎ করেছেন, সেটি প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের বক্তব্যে আসেনি। এ ছাড়া রাডার ক্রয় অনুমোদনের ক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বর্ণিত আসামিরা নিজে লাভবান হওয়ার জন্য এই রাডার ক্রয় করেছেন এটি সাক্ষ্য-প্রমাণে পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবীরা বলছেন রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর তারা এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করবেন। এ মামলায় এরশাদের পক্ষে আইনি শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম। অন্য দুই আসামির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শামসুদ্দিন বাবুল ও আলতাফ হোসেন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় এরশাদের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম সন্তোষ প্রকাশ করেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, এ মামলায় ৩৮ জন সাক্ষী ছিলেন। এর মধ্যে মাত্র ১২ জনকে আমরা হাজির করতে পেরেছি। সাক্ষীদের মধ্যে কেউ মারা গেছেন। কেউ অসুস্থ বিধায় সাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি। তবে, সাক্ষী কম হলেও এ মামলায় যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণ আমরা উপস্থাপন করেছিলাম। তিনি বলেন, আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে কমিশনের (দুদক) সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ফ্রান্সের থমসন সিএসএফ কোম্পানির অত্যাধুনিক রাডার না কিনে বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টিন কোম্পানি হাউজের রাডার কিনে রাষ্ট্রের ৬৪ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯১৮ টাকা আর্থিক ক্ষতির অভিযোগে ১৯৯২ সালের ৪ঠা মে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো এরশাদের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করে। তদন্ত শেষে ১৯৯৪ সালের ২৭শে অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়। ১৯৯৫ সালের ১২ই আগস্ট এরশাদসহ চার আসামির বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এ মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত থাকে। আইনি বাধা শেষে ২০১০ সালের ১৯শে আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে ২০১৪ সালের ১৫ই মে লিখিত বক্তব্য আদালতে জমা দেন এরশাদ। আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন তিনি। ওই দিন মামলার অন্য দুই আসামি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও সুলতান মাহমুদও নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বক্তব্য দেন।
Leave a Reply