বেশ কয়েক বছর আগেও নাটক দর্শকদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে আটকে রাখতে সক্ষম ছিল ভালোভাবেই। আর তা সম্ভব হতো সে সময় নাটকের মান ভালো ছিল বলে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, নাটকের সেই মানের বিষয়টি স্থায়ী থাকেনি। ফলে বর্তমানে দর্শক ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশীয় চ্যানেলের নাটক থেকে। সমসাময়িক নাটকগুলোর মাধ্যমে দর্শক ধরে রাখা সম্ভব হয়ে উঠছে না। ক্রমেই আগের চেয়েও ব্যাপকভাবে নাটক বিমুখ হয়ে উঠছেন দর্শক। দেশীয় চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত প্রচার চলতি অসংখ্য নাটককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কলকাতার চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো তুমুল দর্শকপ্রিয়তায় পৌঁছে গেছে। চ্যানেল বাড়ছে, বাড়ছে নাটক। কিন্তু বাড়ছে না নাটকের মান। ফলাফল যা হওয়ার তা হচ্ছে। দর্শক নাটক দেখছেন না। রিমোট টিপে চলে যাচ্ছেন পার্শ্ববর্তী দেশের চ্যানেলগুলোতে। স্বল্পসংখ্যক নাটক বাদে বেশির ভাগই বস্তাপচা কাহিনী, উৎকট প্রেমনির্ভর নাটক লবিংয়ের মাধ্যমে টিভি চ্যানেলগুলোতে অনায়াসে প্রচার হচ্ছে। এখনকার নাটকগুলোতে দেখা যায় তেমন কোনো কাহিনী নেই। শুধু একটা ভিত্তি আছে। আর তা হলো দেখা-সাক্ষাৎ, গান, ভালোলাগা, প্রেম, ভালোবাসা, কিছুটা নাচানাচি, চকর-বকর মেকাপ, নানারকম ড্রেসআপ, বিয়ে, পরকীয়া, পুরাতন প্রেমিকা, আবার প্রেম, অফিস, কাছে আসা। এভাবেই এগুচ্ছে বেশিরভাগ নাটকের গল্প। ভালো কোনো নির্মাতা চ্যানেলগুলোতে নাটক বিক্রি করতে গেলে এজেন্ট, লবিংয়ের ঝক্কি-ঝামেলার কারণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তলানিতে গিয়ে ঠেকছে তাদের আত্মবিশ্বাস। ঈদের সময় কিছু ভালো মানের নাটক দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচার হতে দেখা যায়। কিন্তু তাও আবার হাতেগোনা। তবে সেই নাটকগুলোও বেশি মানুষ দেখছেন না। অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপন আর সঠিক সময় নাটক প্রচার না হওয়াতে দেশীয় নাটকের ওপর মানুষের যেন এক রকম বিরক্তি ধরে গেছে। তাছাড়া এখন পারিবারিক গল্পনির্ভর তেমন কোনো নাটক নির্মাণ হয় না বললেই চলে। কমেডি নাটকগুলো রূপ নিচ্ছে ভাঁড়ামিতে। জোর করে হাসানোর এক ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার কারণে বিরক্ত হচ্ছেন দর্শক। যারা নাটক বানাচ্ছেন তাদের টার্গেট মূলত তরুণ সমাজ। কিন্তু বাবা-মা, চাচা-চাচিরাও নাটকের বড় দর্শক। আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলেই একসময় প্রচার হয়েছে ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘সংশপ্তক’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘রূপনগর’, ‘জন্মভূমি’, ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘ঢাকায় থাকি’, ‘কোথাও কেউ নেই’র মতো নাটক। যে নাটকগুলোর কাহিনী দর্শক এখনো বলতে পারেন অথচ এখনকার নাটক দর্শক আজ দেখলে কাল ভুলে যান। মনে রাখার মতো কোনো উপাদান থাকে না। এমনই সব অভিযোগ তুলতে দেখা যায় দর্শককে। চ্যানেল যত বাড়ছে ততই হু হু করে বাড়ছে শিল্পীদের সংখ্যা। কিন্তু সে অনুযায়ী নাটকের মান বাড়ছে না। বাড়ছে না ভালো মানের শিল্পীর সংখ্যাও। যার কারণে ঘুরেফিরে একই অভিনয় শিল্পীদের দেখতে হচ্ছে। আগে টিভি নাটকে অভিনয় করতে হলে প্রথমেই একটা বিশাল ধাপ পার হয়ে আসতে হয়। সেই ধাপের নাম মঞ্চ। আর এই মঞ্চ থেকেই উঠে আসে সব ক্ষুরধার অভিনেতা-অভিনেত্রী। যাদের অভিনয়শৈলী দ্যুতি ছড়ায় নাটকগুলোতে। এমন স্বাক্ষর অনেকেই রেখেছেন এ পর্যন্ত। সেসূত্রে দর্শক পেয়েছে সব প্রতিভাধর মুখগুলোকে। পেয়েছে আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, লিটু আনাম, আজিজুল হাকিম, মামুনুর রশিদ, গোলাম মুস্তাফা, সুবর্ণা মুস্তাফা, বিপাশা হায়াত, তৌকীর আহমেদ, জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, বিজরী বরকতউল্লাহ, আফসানা মিমিসহ আরো অনেক শিল্পীকে। অথচ এখন অনেকেই সরাসরি ছোট পর্দায় অভিনয় করে রাতারাতি তারকা বনে যাচ্ছেন। যারা জীবনে অভিনয় করে দেখেন না তাদেরই ধরে এনে নাটকে সুযোগ দেয়া হয়। কেউ বা আবার নাটকে আসছেন দুয়েকটা বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে কাজ করে। সব মিলিয়ে মানসম্পন্ন নাটকের অভাব, বিজ্ঞাপনের দীর্ঘ বিরতি, এক ধারার নাটকের একঘেয়েমি, কমেডির নামে ভাঁড়ামি, ঘুরেফিরে একই অভিনয়শিল্পীর অভিনয়- এসব নানাবিধ কারণে দর্শকরা অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দেশীয় নাটক থেকে। যার ফলে নাটকের সংখ্যা বাড়লেও দর্শকের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। শুধু তাই নয় মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। টিভি নাটকের এমন করুণ পরিণতি থেকে উত্তরণ নিয়ে সবাই বিভিন্ন গণমাধ্যমে কথা বললেও সুষ্ঠু সমাধান আসছে না কিছুতেই। অবশ্য অনেকের দাবি সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় টিভি চ্যানেলগুলোর কাছেই আছে। সব চ্যানেল কর্তৃপক্ষ একসঙ্গে বসলেই এর সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন নাট্যবোদ্ধারা। বিশিষ্ট নাট্যজন ড. ইনামুল হক বলেন, টিভি নাটকের দর্শক কমে যাওয়ার পেছনে কারণ হলো বিশৃঙ্খলা। দর্শক শিল্পী, নির্মাতা কিংবা টিভি চ্যানেল থেকে যেভাবে প্রত্যাশা করেন সেভাবে পাচ্ছেন না। নাটকে ভালো গল্প নেই। এটা একটা বড় কারণ। আমাদের চ্যানেলগুলো নাটক পুনঃপ্রচার করার ক্ষেত্রে ঠিকভাবে করতে পারে না। কোন সময় প্রচার করলে দর্শক দেখতে পাবেন তার কোনো সুষ্ঠু নিয়ম নেই। দেখা যায় রাত দুইটার সময়ও পুনঃপ্রচার করে। তখন তো দর্শক জেগে থাকেন না। আমাদের নাটকে গল্প বলার স্টাইলে সমস্যা রয়েছে। যে কারণে গল্পগুলো হারিয়ে যায়। ভারতীয় চ্যানেলের দিকে তাকালে দেখবেন ওদের বাচনভঙ্গি ও গল্প বলায় মাধুর্য রয়েছে। যেটা দর্শক আকর্ষণের অন্যতম একটি কারণ। তাছাড়া নাটকের ভাষাগত সমস্যা তো আছেই। শুদ্ধ ভাষার চেয়ে আঞ্চলিক ভাষাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন আঞ্চলিক ভাষায় হাসানোর চেষ্টা করলেই দর্শককে টানা যাবে। কিন্তু সেটা ভুল ধারণা। এসবের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্য, এজেন্সি নির্ভরতার সমস্যাগুলো জড়িয়ে আছে নাটকের সঙ্গে। যে ইমপ্রেশন ক্রিয়েট করার কথা তা হচ্ছে না। সবমিলিয়ে নান্দনিক মনটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে। সমস্যা উত্তরণে চ্যানেল বন্ধ করা যাবে না। ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করে কিছুই সম্ভব নয়। ভিশন নিয়ে কাজ করতে হবে। একটা সময় যে জৌলুস ছিল সেটা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দায়িত্বটা সবার নিতে হবে। এদিকে এ প্রসঙ্গে আবুল হায়াত বলেন, টিভি নাটক যা হচ্ছে খারাপ হচ্ছে না। ভালোই করছেন সবাই। এখন তো অনেক টিভি চ্যানেল। সে জায়গায় নাটকও প্রচুর নির্মাণ হচ্ছে। তাই বলা যায়, খারাপ কিছু কাজ থাকলেও সে সঙ্গে ভালোটাও হচ্ছে। আর অনেক কাজের মধ্যে ভালো-মন্দ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ডলি জহুর বলেন, আমি এসব নিয়ে এখন একদমই ভাবি না। ভাবতে চাইও না। আর তাছাড়া এখন নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতারা রয়েছেন। তারাই তাদের মতো করে কাজ করছেন। টিভির বর্তমান সংকট উত্তরণে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন বলেই আমার মনে হয়। আর সেটাই বিশ্বাস করি।
Leave a Reply