স্বর্ণদ্বীপ হতে পারে আরেক সিঙ্গাপুর। আয়তনেও স্বর্ণদ্বীপ সিঙ্গাপুরের মতো।
এটা বাংলাদেশের মূল ভূমি থেকে আলাদা। সমুদ্রও কাছে আছে। সবকিছু মিলে পরিকল্পিতভাবে কাজ করা গেলে স্বর্ণদ্বীপ হবে বিরাট এক সম্ভাবনা।
শনিবার নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার স্বর্ণদ্বীপে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল উদ্বোধনের পর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্ষায় এলাকাটির অনেক অংশ পানিতে তলিয়ে যায়। যদি সমুদ্র রিক্লেইম করে ভূমি উদ্ধার করা যায়, তাহলে বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আসবে এই স্বর্ণদ্বীপ। এজন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশে এমন জায়গা কোথাও নেই। দেশের অন্য জায়গায় দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দিতে গেলে জমির মালিকদের ফসলের টাকা দিতে হয়।
এ জায়গাটা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। এই ধরণের চর না ভাসলে বাংলাদেশের এতো মানুষের জায়গা হবে কোথায়? এটা আল্লাহর রহমত। স্বর্ণদ্বীপ না দেখলে বাংলাদেশ দেখাই আমার বাকি থেকে যেতো।
বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা বিস্তৃত ভূখন্ড স্বর্ণদ্বীপে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় জনবিরল এলাকাটি বাসযোগ্য ও সবুজে সুশোভিত হয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে পরিকল্পিত বনায়ন, সাইক্লোন শেল্টার, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, নারকেল বাগান, ঝাউ বাগান, গরু, মহিষ, ভেড়া, হাঁস, মুরগি কবুতরের খামার। এখানে রয়েছে সবজিবাগান, ধানসহ নানা ধরণের শস্য। ২০টি খামারে প্রায় ১৩ হাজার মহিষ, ১৬ হাজার ভেড়া ও ৮ হাজার গরু পালন করা হচ্ছে। এসব খামার থেকে উৎপাদিত দুধ সংগ্রহ করে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করতে একটি কারখানাও স্থাপিত হয়েছে। সমতল ভূমির এই দ্বীপে মাছ চাষের জন্য তৈরি করা হয়েছে অনেকগুলো পুকুর। সব মিলিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ‘স্বর্ণদ্বীপ’ যেন সত্যিকারের স্বর্ণদ্বীপে রূপান্তর হচ্ছে। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে নৌপথে চলাচলের জন্য সেনাবাহিনী নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করেছে ৩ টি ট্রলার। এছাড়া ভারী যানবাহন পারাপারের জন্য এলসিটি ও এলসিইউ জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। গতকাল শনিবার নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় অবস্থিত ‘স্বর্ণদ্বীপে’ সরজমিনে গিয়ে এমনই চিত্র দেখা যায়।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপ (জাহাজ্জ্যার চর) পরিদর্শনকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং সেনাবাহিনীর তত্তাবধানে নির্মাণাধীন ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আগামী বছরের জুনের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। ৩০কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে হাসপাতাল ভবন, অফিসার্স মেস, স্টাফ কোয়াটারসহ তিনতলাবিশিষ্ট ছয়টি ভবন নির্মাণ করা হবে। রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠা স্বর্ণদ্বীপের ম্যানুভার প্রশিক্ষণ এলাকার সুপরিকল্পিত ব্যবহার দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং স্বর্ণদ্বীপের প্রশিক্ষণ সুবিধা সেনাবাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্বর্ণদ্বীপ-এর অবকাঠামোগত এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক সকল কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সাল থেকে স্বর্ণদ্বীপ-এ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা অবস্থার উন্নতি, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনার দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করছে। ইতোমধ্যে স্বর্ণদ্বীপে গড়ে উঠেছে তিনটি মাল্টিপারপাস সাইক্লোন শেল্টার। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিকল্পিত বনায়ন, উন্নত প্রজাতির নারকেল বাগান, মিলিটারি ফার্ম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা, স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে জেনারেটরের পাশাপাশি ১ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদসহ সামরিক ও অসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মূলত ‘স্বর্ণদ্বীপ’ নামের এই দ্বীপ অঞ্চলটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ এলাকা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ছয়টি পদাতিক ব্রিগেট দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। ২৯ মার্চ ২০১৪ পর্যন্ত প্রায় চার বছরে ২৮ হাজার ৯৬৭টি জনসেনা সদস্য এখানে প্রশিক্ষণ সুবিধা পেয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার পূর্বে প্রাক মোতায়েন প্রশিক্ষণেও স্বর্ণদ্বীপ ব্যবহৃত হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর আধুনিক সব প্রশিক্ষণের জন্য এই দ্বীপটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন এবং সবুজ বনায়নের ফলে নয়নাভিরাম এলাকায় পরিণত হয়েছে ‘স্বর্ণদ্বীপ’। ১৯৭৮ সালে মেঘনা নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠা বিশাল এই দ্বীপ অঞ্চলটি এক সময় জাহাজ্জ্যার চর নামে পরিচিত ছিল। ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৪ কিলোমিটার প্রশস্থ স্বর্ণদ্বীপটি ২০১২ সালে সেনাবাহিনীকে বরাদ্দ দেয় সরকার। এরপর থেকে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণের জন্য স্বর্ণদ্বীপের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নদীর ঘাট থেকে স্বর্ণদ্বীপে স্থাপিত সেনাবাহিনীর ‘ময়নামতি ক্যাম্প’ পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়ক ও ৪টি স্থায়ী হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হয়েছে। রেডিও লিংকের মাধ্যমে এই দ্বীপে চালু করা হয়েছে টেলিফোন, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক সুবিধা। যতই দিন যাচ্ছে পরিকল্পিত উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে স্বর্ণদ্বীপ।
Leave a Reply