জেনেনিন শীর্ষ ১০ সেনাবাহিনীর তালিকা
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের রয়েছে নিজস্ব সেনাবাহিনী। যার কাজ অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রু থেকে নিজ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। এই সেনাবাহিনীর অধিকাংশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরীয় যুদ্ধ, এমনকি গৃহযুদ্ধে জড়িত ছিল।
উপরন্তু এই সামরিক বাহিনী নিজ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য যুদ্ধে সরাসরি জড়িত ছিল। এদের মধ্যে কোনোটা পালন করেছে দায়িত্বশীলের ভূমিকা, আবার কোনোটা হয়েছে নিন্দিত। সেনা সদস্যদের সংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের শীর্ষ ১০ সেনাবাহিনী।
শীর্ষ ১০ সেনাবাহিনীর তালিকা নিচে দেয়া হলঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র:
বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের ৩৯ শতাংশ খরচ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গোটা বিশ্ব খরচ করে ১,৭৫৩ বিলিয়ন ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র খরচ করে ৬৮২ বিলিয়ন ডলার। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দফতর পেন্টাগন. বিশ্বের সবচেয়ে বড় অফিস ভবন। আটলান্টিক মহাসাগর তীরের উত্তর আমেরিকার ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই এই উপনিবেশগুলোর একটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বিদ্রোহী রাজ্যগুলো গ্রেট ব্রিটেনকে পরাস্ত করে।
এই যুদ্ধ ছিল ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসে প্রথম সফল স্বাধীনতা যুদ্ধ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্য, মেঙ্কেিা ও রাশিয়া থেকে জমি অধিগ্রহণ করে এবং টেঙ্াস প্রজাতন্ত্র ও হাওয়াই প্রজাতন্ত্র অধিকার করে নেয়। ১৮৭০-এর দশকেই মার্কিন অর্থনীতি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির শিরোপা পায়। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সামরিক শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা দান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দেশ প্রথম পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্দপ্রকাশ করে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে।
যুদ্ধের শেষভাগে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিধর রাষ্ট্র। সেনা, নৌ, মেরিন কর্পস, বিমান আর কোস্ট গার্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী গঠিত। মার্কিন সামরিক বাহিনী গঠিত হয় ১৭৭৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মিত সেনা সদস্য ১৪,২৯,৯৯৫ জন। রিজার্ভ আর্মি ৮,৫০,৮৮০ জন। আধা সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ১১,০৩৫ জন সদস্য।
রাশিয়া:
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তকালীন রাশিয়া ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলসিন ১৯৯২ সালে ৭ মে সোভিয়েত আর্ম ফোর্সের সদস্য ও সরঞ্জাম নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন রাশিয়ান সামরিক বাহিনী। আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব, উভয় বিশ্বযুদ্ধ এবং শীতল যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিল এই সামরিক বাহিনী। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগে এটি ছিল বিশ্বের অত্যন্ত শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। যা সেই সময় সৈন্য এবং পারমাণবিক অস্ত্র সংখ্যার দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে ছিল। রাশিয়ার সামরিক বাজেট ৯০ দশমিক সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা বিশ্বের মোট সামরিক বাজেটের পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ। স্থল বাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, স্ট্র্যাজিক রকেট ফোর্স, বিশেষ বাহিনী এবং এয়ারবোম ট্রুপস নিয়ে রাশিয়া ফেডারেশনের সামরিক বাহিনী গঠিত।
নিয়মিত সেনা সদস্য ১০,৪০,০০০, রিজার্ভ আর্মি ২০,৩৫,০০০ এবং আধা-সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ৪,৪৯,০০০ জন সদস্য। রাশিয়ার রয়েছে ২২,৭১০টি সাঁজোয়াা ট্যাংক, একটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ১৫টি উভচর যুদ্ধজাহাজ, পাঁচটি ক্রুজার, ১৪টি ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ, পাঁচটি ফ্রিগেট, ৭০টি করভিট যুদ্ধজাহাজ, ৩৩টি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন, ১৭টি সাবমেরিন, ১,২৬৪টি যুদ্ধবিমান, ১৯৫টি বোমারু বিমান, ১,২৬৭টি জঙ্গিবিমান, ১,৬৫৫টি সাঁজোয়া হেলিকপ্টার এবং ১২ হাজার পরমাণু অস্ত্র। রাশিয়া বিশ্বের অনেক দেশে অস্ত্র রপ্তানি করে থাকে।
দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় অটোমেটিক রাইফেল একে-৪৭-এর নির্মাতা ও ডিজাইনার রাশিয়ার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিখাইল কালাশনিকভ। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটিরও অধিক এই অস্ত্র বিক্রি হয়েছে এবং বিশ্বের প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশের সামরিক বাহিনীতে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে যে কোনো দেশের বিদেশি নাগরিক অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। রাশীয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য।
চিন:
চিনের সামরিক ব্যয় ১৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা দেশটির জিডিপির দুই শতাংশ। বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের নয় দশমিক পাঁচ শতাংশ করে চিন ব্যয় করে তাদের সামরিক বাহিনীর জন্য। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে চিনের অবস্থান তৃতীয়। এ দেশের স্থলসীমার দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। এই বিশাল ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে চিনের সেনাবাহিনী_ যার নাম পিপলস লিবারেশন আর্মি বা সংক্ষেপে পিএলএ। প্রতিষ্ঠিত হয় ১ আগস্ট, ১৯২৭। পিএলএর পাঁচটি শাখা হলো : পিএলএ স্থলবাহিনী, পিএলএ নৌবাহিনী, পিএলএ বিমানবাহিনী, দ্বিতীয় গোলন্দাজ কর্পস, পিএলএ রিজার্ভ ফোর্স। চিনের নিয়মিত সেনা সদস্য ২২ লাখ ৮৫ হাজার জন। রিজার্ভ আর্মি আট লাখ। আধা সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ১৫ লাখ সদস্য।
রয়েছে ১০ হাজার ট্যাংক, সুবিশাল গোলন্দাজ ইউনিট, এন্টি ট্যাংক মিসাইল ইউনিট এবং ২৪০টি পারমাণবিক অস্ত্র। পিএলএ নৌবাহিনীতে রয়েছে ৩৫ হাজার কোস্টাল ডিফেন্স ফোর্স। ৫৬ হাজার মেরিন সেনা এবং ৫৬ হাজার রয়েছে পিএলএএন অ্যাভিয়েশনে যারা কয়েকশ বিমান এবং হেলিকপ্টার পরিচালনা করে। নৌবহরে রয়েছে একটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ২৭টি উভচর যুদ্ধজাহাজ, ৪৮টি ফ্রিগেজ জাহাজ, ২৭টি ডেস্ট্রয়ার, ১৫টি কারভিটি জাহাজ, ১০টি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন, ৪০টি সাবমেরিন। পিএলএ বিমানবাহিনী রয়েছে : ৩৭০টি জঙ্গিবিমান, ১১৮টি বোমারু বিমান এবং ১ হাজার ১৩০টি যুদ্ধবিমান।
অস্ত্র উপাদনে চিনের রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। বিশ্বে অনেকগুলো দেশে তারা অস্ত্র রপ্তানি করে থাকে। চিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। প্রতিষ্ঠার পরে পিপলস লিবারেশন আর্মি গৃহযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সীমান্ত সংঘাত থেকে শুরু করে সামরিক প্রতিরক্ষার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিয়েছে।
ভারত:
ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এবং একাধিক অন্যান্য আন্তঃপরিসেবা দাতা সংস্থাকে নিয়ে গঠিত ভারতীয় সামরিক বাহিনী। ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার_ যা বিশ্বের অষ্টম বৃহ বাজেট এবং মোট বাজেটের দুই দশমিক ছয় শতাংশ। ভারতের সামরিক বাহিনীতে মোট ১,৩২৫,০০০ জন নিয়মিত সেনা, ১,১৫৫,০০০ জন সংরক্ষিত সেনা, এবং ১,২৯৩,৩০০ জন আধা-সামরিক সেনা রয়েছে। ভারতীয় উপকূল রক্ষীবাহিনী, কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং স্ট্রাটেজিক ফোর্সেস কমান্ড সেনাবাহিনীর প্রধান সহকারী বাহিনী। বর্তমানে সেনাবাহিনীর ব্যাপক সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের কাজ চলছে। ভারতীয় সামরিক বাহিনী সক্রিয়ভাবে সামরিক মহাকাশ কর্মসূচির পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে।
এ ছাড়া ভারতের সামরিক বাহিনী একটি মিসাইল প্রতিরক্ষা শিল্ড ও পরমাণু ট্রায়াড ক্ষমতাও গড়ে তুলছে। ভারতের সামরিক বাহিনীর ভাণ্ডারে রয়েছে ৫,৯৭৮টি সাঁজোয়াা ট্যাংক, দুটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ছয়টি উভচর যুদ্ধজাহাজ, ১৫টি ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ, ২৮টি ফ্রিগেট, ৩৬টি করভিট যুদ্ধজাহাজ, ৫৪টি পেট্রল বোট, দুটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন, ১৮টি সাবমেরিন, ৯০১টি যুদ্ধবিমান, ৯১টি বোমারু বিমান, ২২০ জঙ্গিবিমান, ১৪০টি সাঁজোয়া হেলিকপ্টার এবং ৯০ থেকে ১০০টি পরমাণু অস্ত্র। ভারতের সামরিক বাহিনীতে নেপাল ও ভুটানের নাগরিকসহ তিব্বতি উদ্বাস্তু যারা স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করছে তারা যোগ দিতে পারে।
ভারতের সামরিক বাহিনী পাক-ভারত যুদ্ধ ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ পর্তুগাল-ভারত যুদ্ধ ও চীন-ভারত যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এই বাহিনী অভ্যন্তরীণ নকশালবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে সাফল্য দেখালেও মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে সমালোচিত হয়েছে।
পাকিস্তান:
সেনা, নৌ, বিমান, মেরিন, আধা-সামরিক এবং এসপিডি বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী গঠিত। ব্রিটিশ ভারতে সামরিক বাহিনীর একটি অংশ নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গঠিত হয় ১৯৪৭ সালে। পাকিস্তানি নিয়মিত সেনা সদস্য ৬,১৭,০০০ জন, রিজার্ভ আর্মি ৫,১৩,০০০ জন এবং আধা-সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ৩,০৪,০০০ জন সদস্য।
পাকিস্তানের রয়েছে ৪,০০০টি সাঁজোয়া ট্যাংক, ৪টি ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ, ১৪টি ফ্রিগেট, ৮টি করভিট যুদ্ধজাহাজ, ২৮টি পেট্রল বোট, ৮টি সাবমেরিন, ৩২৫টি যুদ্ধবিমান, ৩০টি বোমারু বিমান, ২৫০টি জঙ্গিবিমান, ১১০টি সাঁজোয়া হেলিকপ্টার এবং ১১০টি পরমাণু অস্ত্র। পাকিস্তানের সামরিক বাজেট সাত দশমিক আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশটির জিডিপির দুই দশমিক সাত শতাংশ। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বিশেষ রেজিমেন্ট আছে প্যালেস্টাইন ও অন্যান্য আরব জাতিদের জন্য। সামরিক দিক থেকে পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এই বাহিনী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আল-কায়েদা ও তালেবান নির্মূলে কাজ করছে। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র তারা।
জাতিসংঘের শান্তিমিশনেও অংশগ্রহণ রয়েছে এই বাহিনীর। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনী, আলবদর ও আল শামসের হাতে ৩০ লাখ সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, ধর্ষিত হয় ২ লাখ নারী। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্সে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে আত্দসমর্পণ করে।
প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার এই আত্দসমর্পণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সর্ববৃহ আত্দসমর্পণের ঘটনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্বরোচিত এবং ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিন্দিত। এ ছাড়া সামরিক অভু্যত্থান, নির্বাচিত সরকারকে উখাত, পরোক্ষভাবে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ, দ্বিচারিতা ইত্যাদি কারণে বাহিনীটি প্রায় আলোচনা-সমালোচনায় থাকে।
ইরান:
১৯২৫ সালে পাহলাভি সাম্রাজ্য দেশটির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দ্রুততার সঙ্গে আধুনিক ইরানি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে। সেনা কর্মকর্তাদের ইউরোপ এবং আমেরিকার সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সর্বাধিক অস্ত্র আসত মিত্র রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ১৯৪১ সালে ইরানি সামরিক বাহিনী ব্রিটিশ-সোভিয়েত আক্রমণ প্রতিহত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ওমানের সুলতানের পক্ষাবলম্বন করে। বিপ্লব-পূর্ববর্তী সময়ে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল ইরানের।
আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে মোড় নেয়। মার্কিন অবরোধের জন্য ইরান নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নিজেরাই রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা শুরু করে। ১৯৮০-র দশকে দেশটিকে প্রতিবেশী ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। ১৯৮৯ সালে ইরান সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অস্ত্র আমদানি করে সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন শুরু করে।
মার্কিন-ইসরায়েলের শত বাধার পরও দেশটি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্ত সামরিক শক্তি। ড্রোন প্রযুক্তির অধিকারী শীর্ষ পাঁচটি দেশের অন্যতম ইরান। ইরান বিশ্বের সবচেয়ে পর্বতময় দেশগুলোর একটি। ইরানে বিশ্বের অন্যতম বৃহ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার আছে। ইরান প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত অস্তিত্বশীল বৃহ সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশটির মোট আয়তন ১৬,৪৮,০০০ বর্গকিলোমিটার।
ইরানের নিয়মিত সেনা সদস্য ৫,২৩,০০০ জন, রিজার্ভ আর্মি ৩,৫০,০০০ জন এবং আধা-সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ১৫,১০,০০০ জন সদস্য। সেনাবাহিনী, স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং আইআপজিসি নিয়ে ইরানি সামরিক বাহিনী গঠিত। দেশটির সামরিক বাজেট ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তুরস্ক:
তুর্কি সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালের ৩ মে। তুরস্কের নিয়মিত সেনা সদস্য ৬,৬৪,০৬০ জন, রিজার্ভ আর্মি ৩,৭৮,৭০০ জন এবং আধা-সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ১,৫২,২০০ জন সদস্য। সেনা, নৌ, বিমান, ফৌজি-পুলিশ এবং কোস্ট গার্ড নিয়ে তুর্কি সশস্ত্র বাহিনী গঠিত। তুরস্কের রয়েছে ৫,২০০টি সাঁজোয়া ট্যাংক, ৩৪টি উভচর যুদ্ধজাহাজ, ২৫টি ফ্রিগেট, ৯টি করভিট যুদ্ধজাহাজ, ৩৩টি পেট্রল বোট, ১৩টি সাবমেরিন, ৪৬৫টি যুদ্ধবিমান, ৩৬টি সাঁজোয়া হেলিকপ্টার এবং ন্যাটোর পরমাণু অস্ত্র।
সারা বিশ্বের সামরিক বাজেটে তুরস্কের অবস্থান শীর্ষ ১৫-তে। তারা বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের এক শতাংশ ব্যয় করে থাকে। দেশটির সামরিক বাজেট ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশটির জিডিপির দুই দশমিক তিন শতাংশ। ১৯৫২-তে তুরস্ক ন্যাটোতে যোগ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ অবস্থান বিশ্বকে চমকে দেয়। যদিও তুর্কি সেনা কোরিয়ান যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিল। সীমান্তযুদ্ধে রাশিয়া, ব্রিটেন, গ্রিস, ফ্রান্স ও ইতালি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। তুরস্কের মোট আয়তন ৭৮৩,৫৬২ বর্গকিলোমিটার।
১৯২৩ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের তুর্কিভাষী এলাকা আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রাস নিয়ে মুস্তাফা কামাল (পরবর্তীতে কামাল আতাতুর্ক)-এর নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৮ সালে মৃতু্যর আগ পর্যন্ত আতাতুর্ক তুরস্কের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি একটি শক্তিশালী, আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তার সরকারের মূলনীতিগুলো কামালবাদ নামে পরিচিত এবং এগুলো পরবর্তী সব তুরস্ক সরকারের জন্য নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া:
সেনা, নৌ, মেরিন কর্পস, বিমান আর রিজার্ভ বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক কোরিয়ার সামরিক বাহিনী গঠিত। কোরিয়া ভাগের পর দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী গঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। এ দেশের সামরিক বাজেট ৩১ দশমিক সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা বিশ্বের মোট সামরিক বাজেটের এক দশমিক আট শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়মিত সেনা সদস্য ৬,৮৭,০০০ জন। রিজার্ভ আর্মি ১০,০০,০০০ জন।
আধা-সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ৩৫,০০,০০০ সদস্য। দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে ২,৪২৯টি সাঁজোয়া ট্যাংক, ১৮টি উভচর যুদ্ধজাহাজ, ১২টি ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ, নয়টি ফ্রিগেট, ২৮টি করভিট যুদ্ধজাহাজ, ৮৩টি পেট্রল বোট, ১৮টি সাবমেরিন, ৬৪৮টি যুদ্ধবিমান, ৬০টি বোমারু বিমান, ৩৫২টি জঙ্গিবিমান। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী জাহাজ বিধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে।
শুধু উত্তর কোরিয়া নয়, এ অঞ্চলের অপর দেশগুলোর নৌ-জাহাজের হুমকি থেকে দেশকে রক্ষা করাই জাহাজ বিধ্বংসী এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্য। রাশিয়ার ইয়াখন্ত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের আদলে এটি তৈরি করা হচ্ছে এবং এটি শব্দের গতির চেয়ে সর্বোচ্চ আড়াই গুণ বেশি গতিতে পানির ওপর দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম। এ ছাড়া ক্ষেপণাস্ত্রটি সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোমিটার দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। কোরিয়ান যুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ান সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল।
ব্রাজিল:
ব্রাজিল হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহ রাষ্ট্র। এ ছাড়াও জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। আয়তন ৮,৫১৪,৮৭৭ বর্গকিলোমিটার। ব্রাজিলের নিয়মিত সেনা সদস্য ৩,২৭,৭১০ জন। রিজার্ভ আর্মি ১৩,৪০,০০০ জন। আধা-সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ৩,৯৫,০০০ জন সদস্য। স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী নিয়ে ব্রাজিলের সশস্ত্র বাহিনী গঠিত।
ব্রাজিলের রয়েছে ৫৮১টি সাঁজোয়া ট্যাংক, একটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, পাঁচটি উভচর যুদ্ধজাহাজ, নয়টি ফ্রিগেট, পাঁচটি করভিট যুদ্ধজাহাজ, ৩৫টি পেট্রল বোট, সাতটি সাবমেরিন, ২২৩টি যুদ্ধবিমান এবং ১৩টি সাঁজোয়া হেলিকপ্টার। দেশটির সামরিক বাজেট ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশটির জিডিপির এক দশমিক পাঁচ শতাংশ। বিশ্বের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয়ে ব্রাজিলের অবস্থান ১১তম। ব্রাজিল সামরিক বাহিনী ১৮৮৯, ১৯৩০, ১৯৪৫ ও ১৯৬৪ সালের অভু্যত্থান জড়িত ছিল। সর্বশেষ ১৯৬৪ সালের অভু্যত্থানের পরে সামরিক একনায়কতন্ত্র শুরু হয় যা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বলব ছিল।
বর্তমানে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে নেই কোনো গুরুতর বহিরাগত বা অভ্যন্তরীণ হুমকি, তাই সশস্ত্র বাহিনীর জন্য নতুন ভূমিকা অনুসন্ধান চলছে। আমাজন জঙ্গল নিয়ে কাজ করছে ব্রাজিলের সেনারা। এ ছাড়া সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনী বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড যেমন : শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের শান্তিমিশনে যোগ দেয় দেশটির সশস্ত্র বাহিনী।
ফ্রান্স:
বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে একটি হলো ফ্রান্স। সামরিক ইতিহাস ২০০০ বছরের। রোমের পতনের পর অনেকগুলো রাজবংশ ধারাবাহিকভাবে ফ্রান্স শাসন করে। মধ্যযুগে ডিউক ও রাজপুত্রদের রাজ্যগুলো একত্র হয়ে একটি মাত্র শাসকের অধীনে এসে ফ্রান্স গঠিত হয়। বর্তমানে ফ্রান্স এর পঞ্চম প্রজাতন্ত্র পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৫৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। ফ্রান্সই প্রথম বিশ্বকে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র উপহার দেয়। ১৯ শতক ও ২০ শতকের শুরুতে ফরাসি শক্তি ও আর্থিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।
তারা বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় পুরোটাই ফ্রান্সের মাটিতে সংঘটিত হলে দেশটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি উত্তর ফ্রান্স দখল করলে মধ্য ফ্রান্সে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স তার ধূলিসা অর্থনীতিকে আবার গড়ে তোলে এবং বিশ্বের একটি প্রধান শিল্প রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের উপনিবেশগুলোতে সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলন জেগে ওঠে এবং অচিরেই বেশির ভাগ উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
১৯৫৮ সালে আলজেরিয়ায় ফরাসি বিরোধী আন্দোলন ফ্রান্সকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। এই পরিস্থিতি থেকে ফ্রান্সকে বের করে বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ফরাসি নেতা শার্ল দ্য গোল দে। সাম্প্রতিককালে ফ্রান্স জার্মানির সঙ্গে মিলে গোটা ইউরোপের অর্থনীতি ও রাজনীতির সমন্বয়ে প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছে। ফ্রান্স জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশে। ফ্রান্সের নিয়মিত সেনা সদস্য ৩,৫২,৭৭১ জন, রিজার্ভ আর্মি ৭০,০০০ জন এবং আধা-সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ৪৬,৩৯০ জন সদস্য।
Leave a Reply