বাংলাদেশ তখন ইনিংস পরাজয় এড়াতে লড়ছে। ২০১২-র নভেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খুলনা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে দল যখন ৮২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে আরেকটি লজ্জার হার মেনে নেওয়ার অপেক্ষায়, প্রতিরোধের গল্পটার শুরু তখন থেকেই। ব্যাট হাতে যা লিখেছিলেন সাকিব আল হাসান ও নাসির হোসেন।
ইনিংস হার ঠেকাতে আরো ১৮০ রানের প্রয়োজন মেটানো দুঃসাধ্য ব্যাপার বলে মনে হলেও তাঁরা হাল ছাড়লেন না। বরং ষষ্ঠ উইকেটে তাঁদের ১৪৪ রানের পার্টনারশিপে অন্তত ইনিংস ব্যবধানে না হারার ব্যাপারটি অনেকখানি নিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্তু পুরোপুরি নয়। কারণ নার্ভাস নাইনটিজে সাকিব আউট হতে না হতেই মাহমুদ উল্লাহও তাঁকে অনুসরণ করায় উল্টো ইনিংস হারের লজ্জাই চোখ রাঙাতে শুরু করেছিল। তখনো যে ৩ উইকেট হাতে নিয়ে লাগে আরো ৩৬ রান। তবু শেষরক্ষা হয়েছিল টেল এন্ডারদের নিয়ে অবিচল নাসিরে। ক্যারিবীয়দের আরেকবার ব্যাটিংয়ে নামানো নিশ্চিত করে যিনি নিজেও ছিলেন প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির অপেক্ষায়।
সে অপেক্ষা আরো দীর্ঘ হয় নাসিরও সাকিবের মতো নার্ভাস নাইনটিজে আউট হওয়ায়। তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার থেকে মাত্র ৬ রান দূরে থাকতে টিনো বেস্টের বলে বোল্ড হয়ে যান তিনি। এই বিশ্বকাপের ডামাডোলেও যে ইনিংসটির কথা ভুলে যাওয়ার উপায় নেই নাসিরের, কফিনের ডালা খুললেই যে চোখে পড়ে সেই ইনিংস খেলা ব্যাটটি! তাঁর মতো ভাগ্যে বিশ্বাস নেই সাকিবের। তাই বিশ্বকাপে ব্যাটিং করার জন্য নিয়ে গেছেন নতুন নতুন সব ব্যাট। নাসিরও নিয়ে গেছেন বেশ কিছু নতুন ব্যাট। তবে সংস্কার থেকে সঙ্গে নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৪ রানের ইনিংস খেলা সেই ব্যাটটিও। যে ব্যাটের মহিমা ওই একটি ইনিংসেই লুকিয়ে নেই।
ওই ব্যাট তো আরো বড় প্রাপ্তির স্বাদও দিয়েছে তাঁকে। একই ব্যাটে ধরা দিয়েছে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির অপূর্ণ স্বপ্নও। তাও আবার তিন মাসের মধ্যে। খুলনার পর বাংলাদেশের পরবর্তী টেস্ট ছিল ২০১৩-র মার্চে। শ্রীলঙ্কা সফরে গলে সিরিজের প্রথম টেস্টেই নাসিরের সেঞ্চুরিটা অবশ্য ঢাকা পড়ে থাকে মুশফিকুর রহিমের ব্যাটে বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি এবং মোহাম্মদ আশরাফুলের ১৯০ রানের ইনিংসের ছায়ায়। কিন্তু নিজের মনের আয়নায় তো সেটি থেকেই সবচেয়ে বেশি আলো প্রতিফলিত হয়। সৌভাগ্যের খোঁজে সেই ব্যাটও তাই বিশ্বকাপ অভিযানে নাসিরের সঙ্গী।
বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের শেষ সিরিজের দলেই ছিলেন না নাসির। বাজে ফর্মের কারণে জায়গা হারানো এ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান সেটি ফিরে পেয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের পারফরম্যান্স দিয়ে। বিশ্বকাপই তাই ‘ফিনিশার’ খ্যাত এ ব্যাটসম্যানের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ। যে মঞ্চে ওঠার আগে প্রস্তুতি ম্যাচে হারের পর হার জর্জর দলকে সাফল্যের পথ দেখাতে দলের অন্য অনেকের মতো নাসিরও টোটকায় আস্থা রাখছেন, ‘আমি এবার চারটি ব্যাট নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে তিনটিই নতুন। পুরনো ব্যাট একটাই। আমার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিও ওই ব্যাট দিয়েই করা। তার আগে একটি ৯৪ রানের ইনিংসও আছে। আগে বড় বড় ইনিংস খেলেছেন, এমন ব্যাট দিয়ে খেললে সুফলও পাওয়া যায়। আর কেউ করুক না করুক, আমি অন্তত বিশ্বাস করি।’
নাসিরের মতো এমন বিশ্বাসের জায়গা আছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলের আরো কয়েকজনেরও। তবে ব্যতিক্রমও আছেন কেউ কেউ। যেমন দলের দুই সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব ও তামিম ইকবাল। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের প্রত্যেকে গড়ে চারটি করে ব্যাট নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে ওই দুজন পুরনো ব্যাট নিয়ে যাননি একটিও, সবই নতুন। তাঁদের ফেলে দেওয়া ব্যাট মানেই একেবারে বাতিল নয়, জায়গা খুঁজে নেয় সতীর্থদের কফিনে। সেগুলো গুণে-মানে এতই আকর্ষণীয় যে অন্যরা অপেক্ষায় থাকেন কখন সাকিব-তামিমদের কফিনে ঢুকবে নতুন ব্যাট!
প্রস্তুতি ম্যাচে (৮৩ বনাম পাকিস্তান, ৪২ ও ৩৬ বনাম ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া একাদশ, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেননি) বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান মাহমুদ উল্লাহও নিয়ে গেছেন কয়েকটি ব্যাট। সঙ্গে আছে পুরনো এবং ব্যবহৃত দুটো ব্যাটও। যে দুটো ব্যাটের সঙ্গেও সংস্কারের যোগ আছে। ব্যাট হাতে বড্ড খারাপ সময় পার করতে থাকা এ ব্যাটসম্যান ‘ফাঁড়া’ কাটিয়ে দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ে সিরিজেই ফিরে পান নিজেকে। প্রথম দুই টেস্টের তিন ইনিংসেই ফিফটি! ওয়ানডে সিরিজের শেষ তিন ম্যাচে ৩৩*, ৮২* ও ৫১*! সেসব ইনিংস খেলেছেন যে দুটো ব্যাট দিয়ে, বিশ্বকাপেও নিয়ে গেছেন সেই ব্যাট জোড়া। বিশ্বকাপ-ভাগ্য রাঙানোর উদ্দেশ্যটা তাতেই পরিষ্কার।
জিম্বাবুয়ে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতেই অভিষিক্ত সৌম্য সরকারের অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সাফল্য দিয়ে সংস্কারাচ্ছন্ন হওয়ার উপায় ছিল না। খেলেছেনই মোটে একটি ওয়ানডে, তাতে ২০ রানের ইনিংস মোটেও উল্লেখযোগ্য নয়। তবে যে আসরের পারফরম্যান্স দিয়ে তাঁর বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেওয়া, সেই প্রিমিয়ার লিগে ব্যবহৃত কিছু ব্যাটে তিনিও সাফল্যের সূত্র খুঁজবেন, ‘আমি ভারী ব্যাটে খেলতে অভ্যস্ত। নিয়ে এসেছি চারটি ব্যাট। এর মধ্যে দুটো দিয়ে সবশেষ প্রিমিয়ার লিগে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে একটি সেঞ্চুরি ও চারটি ফিফটিসহ ৬১৫ রান করেছিলাম। আশা করছি, সেসব ব্যাটে বিশ্বকাপেও রানের দেখা পাওয়া যাবে।’ একই রকম আশা অলরাউন্ডার সাব্বির রহমানেরও, ‘আমার এমন একটা ব্যাট আছে, যেটিকে আমি সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করি। ওই ব্যাট দিয়ে যদি নাও খেলি, তবু অন্যান্য ব্যাটের সঙ্গে সেটি থাকেই থাকে। আছে এই বিশ্বকাপেও।’
সব প্রস্তুতি ম্যাচের হারে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে যখন প্রত্যাশার বেলুন রয়েসয়েই ফুলছে, তখন সংস্কার থেকেও সাফল্যের খোঁজ মিললে খারাপ কী! ক্রিকেটে ভাগ্যের ছোঁয়া লাগেও।
Leave a Reply