বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রাত সাড়ে ৯টায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। থাইল্যান্ডে অবস্থানরত সৈয়দ আশরাফের ভাই মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ সাফায়েত ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, আগামীকাল শনিবার সৈয়দ আশরাফের লাশ দেশে আনার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। মৃত্যুকালে তিনি এক মেয়ে, ভাই-বোনসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সৈয়দ আশরাফ থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে ছুটি নেন। দেশে না থেকেও সৈয়দ আশরাফ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসনে নৌকা প্রতীকে জয়ী হন। গতকাল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচিত এমপিরা শপথ নিয়েছেন। সকালে নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। তবে শপথ নেওয়ার জন্য সময় চেয়ে তার চিঠিটি গতকাল স্পিকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।
গত রাতেই আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ হাসপাতালে সৈয়দ আশরাফের ভাইবোনদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার হাসপাতালে অবস্থান করছেন। এর আগে দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে তার স্ত্রী শিলা ইসলামও ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা যান।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালে ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং টানা দুবার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্যু তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর শেখ হাসিনা কারাবন্দী হলে আওয়ামী লীগের যে কজন নেতা দলের হাল ধরেছিলেন, তার অন্যতম ছিলেন সৈয়দ আশরাফ।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়। বাবার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাজ্যে চলে যান এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সদস্য ছিলেন।
১৯৯৬ সালে সৈয়দ আশরাফ দেশে ফিরে আসেন এবং জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০১ ও ২০০৮ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রিসভা গঠিত হলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পুনরায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। এক মাস এক সপ্তাহ পর ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিজের অধীনে রাখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।
সৈয়দ আশরাফের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি এক-এগারোর সময় দলের কঠিন পরিস্থিতিতে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন। দলের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দলীয় সভানেত্রীর মুক্তি আন্দোলন ত্বরান্বিত করে তাকে কারামুক্ত করেন এবং সেনাসমর্থিত সরকারের কাছ থেকে জাতীয় নির্বাচন আদায় করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ও ২০১২ সালের ২৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ টানা দুবার দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকালে সংকটময় মুহূর্তে যখন দলের সব নেতা নীরব ভূমিকায় ছিলেন, তখন তিনি সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতকে ঢাকা ছাড়ার সময় বেঁধে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। তার হুমকিতে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হেফাজত নেতা-কর্মীদের ঢাকা থেকে বিতাড়ন করা হয়। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে কূটনৈতিক দূতিয়ালিতে তিনি সফলতার পরিচয় দেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে টানা দুই মেয়াদ দেশ শাসন করে। সৈয়দ আশরাফ একজন ভদ্র, নির্লোভ, দেশপ্রেমিক ও সজ্জন হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও ক্ষমতা দেখানো বা কারও সঙ্গে তিনি দুর্ব্যবহার করেছেন এমন অভিযোগ ছিল না। তিনি নীরবে কাজ করতে পছন্দ করতেন। দলের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন হারাল এক বিশাল হৃদয়ের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদকে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একে অন্যের সঙ্গে শোকবাণী বিনিময় করেন। কাল মরহুমের লাশ দেশে আসার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট এজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে জানা গেছে। আজ সকালে দূতাবাসে তার প্রথম জানাজা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দূতাবাস সূত্র।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক : রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন স্বাক্ষরিত এক শোকবার্তায় জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। রাতে এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন মহৎপ্রাণ, সৎ, নীতিমান, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হারাল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হারিয়েছে একজন আদর্শবান, ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। আরও শোক : আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, লে. জে. এম এফ আকবর (অব.) জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, আওয়মাী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানসহ বিভিন্ন ব্যক্তি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
Leave a Reply