ডেইলি চিরন্তনঃরোদের আড়াল হতে চোখে উঠে যায় চশমা। ধুলোর প্রকোপে চশমা উঠে যায় চোখে। চোখের ব্যথা বেড়ে গেলে চশমা আসে। দৃষ্টির আয়ু ফুরালে চশমা হয় অত্যাবশ্যক। দূরের জিনিস কাছে থাকে চশমায়। কাছের ঝাপসা স্পষ্ট হয় চশমায়। এসব ছাপিয়ে চশমা অনেক সময়েই ফ্যাশনে, ভাবসাবে।
ইতালির জিওর্দানো দা পিসা প্রথম চশমা তৈরি করেছিলেন ১২৮৬ সালে। তবে আধুনিক চশমার উদ্ভাবক গিরোলামো সাভোনারোলা। দু’জনেই ইতালির নাগরিক। তিনি ১৭২৭ সালে বর্তমান সময়ের চশমার প্রাথমিক নকশাটি তৈরি করেন। তার আগে দুই চোখের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা এড়াতে চোখের সামনে কাচ ধরা হতো। সাভোনারোলার নকশাটিকে স্থির রেখে এরপর চশমার নকশা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এটি পায় আধুনিক চেহারা।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য চোখে কাচের ব্যবহারের লিখিত প্রমাণ রয়েছে। রোমান সম্রাট নিরোর একজন শিক্ষক ওই সময়ের বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনার সঙ্গে দূরের জিনিস পরিষ্কারভাবে দেখার জন্য জলমিশ্রিত এক ধরনের কাচ চোখে লাগানোর কথা বলেছেন। রোমান গ্ল্যাডিয়েটরসদের লড়াই উপভোগ করতে গিয়ে নিজের আসনে বসে রোমান সম্রাট নিরো বিশেষ কাচ চোখে লাগাতেন এমন নজিরও ইতিহাসে রয়েছে।
সত্যিকারের চশমা বলতে যা বোঝায় তা প্রথম প্রচলিত হয় ইতালিতে দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের দিকে। ওই সময় চোখে আতশী কাচ লাগিয়ে ছোট জিনিসকে দৃষ্টিসীমায় নিয়ে আসার জন্য চোখে চশমা ব্যবহার করার নজির রয়েছে ইতিহাসে। ১২৮৬ সালের দিকে ইতালিতে প্রথম চশমা তৈরি হয়েছিল। জিওর্দানো দা পিসা নামের এক ব্যক্তি প্রথমবারের মতো চশমা তৈরি করেছিলেন। দা পিসার তৈরি চশমার উদ্দেশ্য ছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার প্রতিকার। কিছুদিন পরে ১৩০১ সালে ভেনিস সরকার চশমা বিক্রির জন্য কিছু নিয়মও ঠিক করে দিয়েছিল। অর্থাৎ ততদিনে চশমা ব্যবসাও শুরু হয়ে যায়। তবে এমন দাবি উঠেছিল, ফ্লোরেন্সের সালভিনো দি’আর্মাতো নামে একজন আরো আগে চশমা আবিষ্কার করেছিলেন বলে। কিন্তু পরে আরো গবেষণা করে দেখা গেল, সেটা নিছকই একটা গুজব।
আবার বিখ্যাত পরিব্রাজক, যিনি হেঁটেই পৃথিবীর অর্ধেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন সেই মার্কো পোলো লিখেছিলেন তিনি নাকি ১৩ শতকেই চীনে চশমা ব্যবহার করতে দেখেছেন। কিন্তু এমন কথা খোদ চীনেরও কেউ লেখেননি। অন্যদের লেখায় চীনে প্রথম চশমার উল্লেখ পাওয়া যায় আরো পরে ১৫ শতকে। আরো উল্লেখ রয়েছে সেই চশমা নাকি আমদানি করা হয়েছিল। সবচেয়ে পুরনো চশমার ছবিটা এঁকেছিলেন তোমাসো দ্য মোদেনা নামে এক ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী। আসলে তিনি একজন বেশ উচ্চপদস্থ লোকের পড়ার ছবি এঁকেছিলেন। আর সেই সময়ে লোকটি চশমা পড়ে ছিলেন। যার কারণে ১৩৫২ সালে আঁকা হয়ে যায় পৃথিবীর প্রথম চশমার ছবি।
চশমা আবিষ্কৃত হলেও, চশমা কীভাবে কাজ করে সেই ব্যাখ্যা তখনো মানুষ ঠিক বের করতে পারেনি। ১৬০৪ সালে প্রথম এই ব্যাখ্যা দেন জোহান্স কেপলার। বাইফোকাল চশমায় দুটি ভিন্ন পাওয়ার থাকে। এই চশমা প্রথম উদ্ভাবন করেন বিখ্যাত আমেরিকান বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। অনেকে তার এই কৃতিত্বের দাবিদার করেন জর্জ হোয়াটলে আর জন ফেনোকেও। কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত হয়, এই কৃতিত্বটি তার। ধারণা করা হয়, তিনি হয়তো তারও বেশ আগেই বাইফোকাল চশমা উদ্ভাবন করেছিলেন। একদম পুরনো আমলের চশমার ফ্রেমগুলোকে এখন বেশ অদ্ভূত মনে হবে। ওগুলোর কোনো ডাণ্ডা থাকত না। হয় হাত দিয়ে ধরে ধরে পরতে হতো, না হয়, নাকের ওপর ঠেস দিয়ে রাখতে হতো।
প্রথম চশমার ফ্রেমে ডাণ্ডার ব্যবহার করা হয় ১৭২৭ সালে। প্রথম ডাণ্ডার ব্যবহার করেন সম্ভবত ব্রিটিশ চক্ষুবিদ অ্যাডওয়ার্ড স্কারলেট। কিন্তু সেই ডিজাইন তেমন ভালো হয়নি। পরে ফ্রেমের আরো অনেক উন্নতি হয়।
আধুনিক কালে চশমা নিজেই ভাগ হয়ে গেছে নানান কাজে। চশমা এখন অন্যতম অনুষঙ্গ।
চশমা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন—পাওয়ার চশমা, রোদ চশমা ও নিরাপত্তামূলক চশমা।
পাওয়ার চশমা : এই চশমা চোখের পাওয়ার বা দৃষ্টিজনিত অসুবিধা ঠিক করতে সাহায্য করে। যাদের চোখের দৃষ্টিশক্তি কম থাকে, তারাই এই চশমা ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দুই ধরনের। কেউ দূরে কম দেখলে তাদের জন্য এক ধরনের চশমা ব্যবহার করতে হয়। এটাকে বলা হয় ইউনিফোকাল চশমা। এই চশমা সব সময় ব্যবহার করা ভালো। সাধারণত অল্পবয়সীরা এ সমস্যায় বেশি পড়ে। আরেক ধরনের সমস্যায় মানুষ দূরের বস্তু ভালো দেখতে পায়, কিন্তু কাছের বস্তু ভালো দেখতে পায় না। সাধারণত ৪০ বছর পার হয়ে গেলেই এ সমস্যা দেখা দেয় ও এটাকে বলা হয় চালশে। তখন তারা এই চশমাটা শুধু কাছে দেখার জন্য ব্যবহার করে। এটাকে বলে রিডিং গ্লাস। এই চশমাটা শুধু পড়াশোনা ও কাছের কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। সব সময় ব্যবহার করার দরকার নেই। আবার কারো কারো কাছে ও দূরে—উভয় দৃষ্টিতেই স্বল্পতা দেখা যায়। তারা ঠিক দূরেও ভালো দেখে না, কাছেও ভালো দেখে না। তাদের জন্য যে চশমা ব্যবহার করা হয় তাকে বাইফোকাল অথবা মাল্টিফোকাল বলা হয়। এই চশমার ওপরের অংশ দূরে দেখার জন্য আর নিচের অংশ কাছে দেখার জন্য সাহায্য করে। পাওয়ার চশমা ব্যবহার করে চোখের দৃষ্টিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা হয়। যেমন—যাদের দৃষ্টিশক্তি বেশি, তাদের চশমায় মাইনাস পাওয়ার (অবতল লেন্স) দেওয়া হয়। যাদের দৃষ্টিশক্তি কম তাদের চশমায় প্লাস পাওয়ার (উত্তল লেন্স) দেওয়া হয়। চশমা দিয়ে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমবেশি করা যায় না, কিন্তু নিউট্রালাইস বা নিরপেক্ষ করা হয়, যাতে সে স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারে।
রোদ চশমা : রোদ চশমা সাধারণত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতির হাত থেকে চোখ নিরাপদ রাখতে ব্যবহূত হয়। এটা সব সময় যে রঙিন হয় তা নয়। কিছু চশমা আছে, যা দেখতে সাধারণ চশমার মতোই; কিন্তু রোদে গেলে কালচে হয়। এটা ফটোক্রোমাটিক বা অটো চশমা নামে পরিচিত। যদিও রোদ চশমা বললে ফ্যাশন বেশি বোঝানো হয়, বাস্তবে এর কিছু জরুরি কাজ আছে। যেমন—যারা রোদে অতিসংবেদনশীল (মাইগ্রেনের রোগী), তারা সংবেদনশীলতাজনিত অসুখ থেকে বাঁচতে এ ধরনের চশমা ব্যবহার করে। চোখের অপারেশনের পরও চোখের দ্রুত সুস্থতার জন্য রোদ চশমার ব্যবহার জরুরি। এ ছাড়া অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব থেকে বাঁচার বিষয় তো আছেই।
নিরাপত্তামূলক বা প্রটেক্টিভ গ্লাস : নিরাপত্তামূলক চশমা বলতে বোঝায়, চোখে আঘাত লাগতে পারে বা চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কিছু থেকে চোখ রক্ষা করতে যে ধরনের চশমা ব্যবহার করতে হয়। অন্যান্য চশমার তুলনায় এ চশমা অনেক মজবুত হয়, ফ্রেম ও গ্লাস দুটিই আকারে বড় হয়। এ ধরনের চশমা সাধারণত রাসায়নিক নিয়ে ল্যাবরেটরিতে যারা কাজ করে, রোগীর কাজ করার সময় ডেন্টিস্ট, ওয়েল্ডিং কারখানার শ্রমিক, বাইকচালক, নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, কল-কারখানায় কাজ করে এমন মানুষরা ব্যবহার করে থাকে।
তথ্য – ইন্টারনেট
Leave a Reply