১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দ ১১ই জৈষ্ঠ ) বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী ফকির আহমদ ও জায়েদা খাতুনের কোল জুড়ে যে শিশুটির আগমন হলো সে আর কেউ নয় – নজরুল । ভালো নাম কাজী নজরুল ইসলাম । ছোটবেলা তিনি দুখু মিয়া নামেই পরিচিত ছিলেন ।
ছোট থেকেই নজরুল ছিলেন অত্যান্ত মেধাবী ।দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ৪৯ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিক হয়ে প্রথম মহাযুদ্ধে যোগদান করেন ।নজরুলের প্রাতিষ্টানিক পড়াশোনা এখানেই সমাপ্তি ঘটে ॥
১২ বছর বয়সে “লেটোর গানের দলে “ যোগ দিয়ে সামান্য রোজগার করতেন ।এর পর আসানসোলের একটি রুটির দোকানে মাসিক ১(এক ) টাকা বেতনে চাকরি নেন ।সৈনিক হিসেবে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি কাব্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন । সাংবাদিক হিসাবেও তিনি যথেষ্ঠ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন । তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় __নবযুগ , লাঙল , ধূমকেতু পত্রিকা । ১৯২০ সালে তিনি পুরোপুরি সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন । তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম “মুক্তি “। কিন্তু যে কবিতা তাকে খ্যাতি এনে দেয় তার নাম “বিদ্রোহী “॥
ঝাকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো এই মহা নায়কের ছিল বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবাধ ও স্বাচ্ছন্দ বিচরণ ।বাংলা তথা উপমহাদেশের মুসলিম -হিন্দু এই দুই প্রধান জাতীর ঐতিহ্য অনুসরনেই নজরুল রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা ও গান ।
বিশ্বজনীনতার দাবীদার যে – এক্ষেত্রে নজরুলের অবদান রবীন্দ্রনাথ থেকেও অনেক বেশী ।
তিনি যে শুধু বড়দের জন্যই লিখেছেন তা কিন্তু না , বড়দের লেখার পাশাপাশি ছোটদের জন্যও রচনা করেছেন অনেক
গুলো কাব্যগ্রন্থ : তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো – *ঝিঙেফুল , *অগ্নিবীণা ,*বিষের বাঁশি* মরু ভাস্কর * ছায়ানট ,সর্বহারাসহ বেশ কয়েকটি ।
তাঁর উপন্যাসগুলো-মৃত্যুক্ষুধা ও কুহেলিকা।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমেদের ভাষায় বলতে হয় : নজরুলের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে মুসলিম লেখকরা ছিল কোণঠাসা , অপাঙতেয় , দূর্বল , অসন্তুষ্ঠ – Defensive Minority.
নজরুলের আবির্ভাব একদিনে করে তাদের তোললো আত্মবিশ্বাসী , অভিজাত -Aggressive Minority.
নজরুল ইসলাম একদিন বিনা নোটিশে “ আল্লাহু আকবর “ তাকবিরের হায়দরী ডাক মেরে ঝড়ের বেগে এসে বাংলা সাহিত্যের দূর্গ জয় করে বসলেন । মুসলিম বাংলার ভাঙ্গা নিশান উড়িয়ে দিলেন , এক দিনে দূর করে দিলেন মুসলিম বাংলার ভাষা ও ভাবের হীনমন্যতা !
বাংলায় মুসলিম জাগরণের যে ধারায় একদিন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয় তার মূলে এই ; এ কারণেই নজরুলের অবদান রীতিমতোঐতিহাসিক ।নজরুলকে যে বাংলাদেশের জনগন তাদের জাতীয় কবি বলে গ্রহণ করেছে তার পটভূমি এটাই ।
বাংলা কাব্য জগতের এই মহা নায়কের পরিচয় নতুন করে দিতে হবে বলে মনে হয় না । তাঁর অসামান্য লেখা :-
“অন্যের দাস করিতে কিংবা নিজের দাস হতে ওরে
আসেনিকো দুনিয়ায় মুসলিম , ভূলিলি কেমন করে ?
ভাঙ্গিতে সকল কারাগার ,সব বন্ধন ভয় লাজ
এল যে কোরান , এলেন যে নবী ,ভূলিলি সে সব আজ ?”
( আজাদ )
তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের কারণে তাঁকে ১৯২৯ সালে কলকাতা ‘অ্যালবার্ট ‘ হলে নজরুলকে জাতীর পক্ষ থেকে সম্মাননা জানানো হয় ।১৯৩৮?সালে কলকাতায় অনুস্টিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির পদে সমাসীন করে সম্মান দেখানো হয় ।১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয় ‘জগত্তারিনী ‘ স্বর্ন পদক প্রদান করে । ১৯৬০ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ ‘ উপাধি দেয়ে । ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবর রহমানের প্রচেস্টায় অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিস্টিত করা হয় । ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে “ডি.লিট “উপাধি প্রদান করা হয় ।১৯৭৬ সালে তুনি ২১ শে পদক লাভ করেন ।
উল্লেখ্য যে ১৯৪২ সালে কবি মস্তিস্কের পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পরেন । তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হলেও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি । এর পর থেকেই তিনি মৃত্যুর পর্যন্ত ছিলেন নির্বাক ।১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১৩৮৩ বঙ্গাব্দ ১২ ই ভাদ্র ) এই মহান কবি , আমাদের জাতীয় কবি মৃত্যুবরণ করেন ।
Leave a Reply