জামিনে মুক্ত ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন ও অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে রোববার কারাগার থেকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। তখন পরিবারের সদস্যরা তাকে দেখতে যান। তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দুপুর দেড়টায় কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে আরিফুল ইসলামকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানে তাকে দেখতে আসেন স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতুসহ তার স্বজনেরা। এসময় আরিফের হাতে-পায়ে, শরীরে ও মাথায় অসংখ্য লাঠির আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়ে কান্না ভেঙ্গে পড়েন তারা।
মধ্যরাতে বাসার দরজা ভেঙে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের অফিসে নিয়ে নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আরিফুল বলেন, শুক্রবার রাত ১২টার পর খেয়ে শুয়ে পড়ার পর একজন বাড়ির দরজায় ধাক্কা দেন। পরিচয় জানতে চাইলে কেউ পরিচয় জানায়নি। পরে আমি সদর থানার ওসিকে ফোন দেই। ফোন দেওয়ার কথা শুনে বাইরে থাকা আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার-রাজস্ব) নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন লোকজন দরজা ভেঙে বাসায় ঢোকে। ঘরে ঢুকেই আরডিসি নাজিম উদ্দিন মাথায় কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন। মারতে মারতে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চোখ-হাত-পা বেঁধে ফেলে। এরপর অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে এনকাউন্টার দিতে চায়। বারবার বলে, ‘তুই কালেমা পড়ে ফেল তোকে এনকাউন্টার দেওয়া হবে’।
নির্যাতনের ফলে আরিফের হাত ফুলে যায়। ভয়াবহ সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, এসময় তাদের আমি অনেক অনুনয় বিনয় করি। আমার প্রাণভিক্ষা চাই। বলি, আমার বাবা-মা নেই, আমার দু’টি সন্তান আছে। আমাকে যেন না মেরে ফেলা হয়। তাহলে আমার বাচ্চা দু’টি এতিম হয়ে যাবে। পরে তারা আমাকে গাড়িতে করে একটি ভবনে নিয়ে যায়। আমি চোখের কাপড় একটু খুলে বুঝতে পারি এটা ডিসি’র কার্যালয়। আবার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারধর করে এবং বলে ‘তোর ভিডিও করে রাখছি’। এসময় অকথ্য ভাষায় গালাগালি করা হয়। এসময় নিজাম উদ্দিন বারবার আরেকজনকে বলছিলেন, ডিসি স্যারকে ফোন দাও, মেসেজ দাও। কী করবো সেটা বলতে বলো?
তিনি আরও বলেন, আমি বারবার জানতে চেয়েছি, আমার অপরাধ কী? তখন নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘তুই আমাদের অনেক জ্বালিয়েছিস। তোকে সাংবাদিকতা শেখাবো।’ এরপর চোখ বাঁধা অবস্থায় চারটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। রাতেই আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। আমাকে কেন কারাগারে পাঠানো হলো এবং কেন ধরে আনা হলো কিছুই বলা হয়নি। এমনকি কারাগারে আমার সঙ্গে একমাস কেউ যেন সাক্ষাৎ করতে না পারে এবং আমার যেন চিকিৎসা দেওয়া না হয় এজন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরিফ আরও বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় কারা কর্তৃপক্ষ একটি ‘কাগজ দিয়ে বলেন, তোমার পরিবার পাঠিয়েছে ওকালতনামায়। সেখানে স্বাক্ষর করতে বলে। আমি স্বাক্ষর করেছি কিন্তু আমি জানি না কে বা কারা ওকালতনামা পাঠিয়েছে। বাইরে এসে জানতে পারলাম আমার পরিবারের সদস্যরা কেউ জামিন আবেদনের জন্য ওকালতনামা পাঠায়নি।’
আরিফুলের ওকালতনামা পাঠানো আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয় তার পরিবার কি আপনাকে নিয়োগ করেছে? এই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি আহসান হাবীব নিলু তারসঙ্গে যোগাযোগ করে দু’জনে মিলে ২৫ হাজার টাকা জামানতে জামিন করিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থপেডিক) উত্তম কুমার রায় বলেন, ‘আমরা তার শারীরিক অবস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। বিস্তারিত লিখিত আকারে তত্ত্বাবধায়ক আবু মোহাম্মদ জাকিরুল ইসলামের কাছে জমা দেওয়া হবে।’
তত্ত্বাবধায়ক আবু মোহাম্মদ জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও জানি। আমরা শুনেছি একটি মোবাইল কোর্ট তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, একজনক ভদ্র ব্যক্তিকে এভাবে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, জখম করা হয়। ইতোপূর্বে আমরা কখনও শুনিনি। হাসপাতালের সব চিকিৎসক ও নার্সকে তার সুচিকিৎসা নিশ্চিতের নির্দেশ দেওয়া আছে।’
হাসপাতালে আরিফুল ইসলামকে দেখতে আসা ঢাকা ট্রিবিউনের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মো. শাহ আলম বলেন, ‘তার শরীরে এত আঘাতের চিহ্ন কেন? মোবাইল কোর্টে কি কাউকে আঘাত করা যায়? আমরা সুবিচার চাই। জেলা প্রশাসকের শাস্তি চাই।’
কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান বিপ্লব বলেন, ‘অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ আদালত দেখেছি। কিন্তু, এভাবে কাউকে পেটানো হয়, তা দেখিনি, শুনিওনি। সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম একজন কলেজশিক্ষকও। তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছে। এটি কেমন ভ্রাম্যমাণ আদালত? তার বিরুদ্ধে করা মামলাও প্রত্যাহার চাই। জেলা প্রশাসকের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
Leave a Reply