দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা টানা অবরোধের সঙ্গে ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিনের হরতালে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সময়সূচি। ১৫ লাখ শিক্ষার্থীকেই পরীক্ষাকেন্দ্রে বসতে হয়েছে অজানা আতঙ্ক নিয়ে। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হতে পারেনি একটি পরীক্ষাও। সব পরীক্ষাই নেওয়া হয়েছে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার। সূচি অনুযায়ী গত ১০ মার্চ পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র ১১ দিনের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিকে বিএনপি জোট হরতাল না ডাকার মতো কোনো মনোভাব দেখাচ্ছে না। এ অবস্থার মধ্যেই আগামী ১ এপ্রিল শুরু হওয়ার কথা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। কিন্তু পরিস্থিতি একই রকম থাকলে নির্ধারিত দিনে ওই পরীক্ষা শুরু হলেও তা শেষ হতে লাগবে চার মাস। এ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষার্থী। সময়সূচি এলোমেলো হয়ে পড়ার সম্ভাবনায় তাদের প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষার মধ্যে বিস্তর ফারাক। এসএসসি পরীক্ষা ১৫ দিনের, অন্যদিকে এইচএসসিতে রয়েছে ৩০ দিনের পরীক্ষা। এ ছাড়া এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। যদি এইচএসসির ফল দিতে দেরি হয়, তাহলে পেছাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাও। এতে সেশনজটে আক্রান্ত হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা আগামী ১ এপ্রিল শুরু হয়ে তা শেষ হওয়ার কথা ১১ জুন। এরপর ব্যবহারিক পরীক্ষা চলার কথা ১৩ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত। কিন্তু এখনকার মতোই হরতাল থাকলে এইচএসসি পরীক্ষাও নেওয়া হবে না। আর হরতালের কারণে কেবল শুক্র-শনিবারে পরীক্ষা নিতে হলে ৩০ দিনের সাপ্তাহিক ছুটির প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে জুলাই মাসের মধ্যেও পরীক্ষা শেষ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। কারণ এ সময়ের মধ্যে রোজা ও ঈদ রয়েছে। আবার এইচএসসি পরীক্ষার মাঝখানে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
শিক্ষকরা জানান, এইচএসসি পরীক্ষা নিতে যদি চার মাস সময় লাগে তাহলে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমও ওই সময়ে বন্ধ রাখতে হবে। অথচ ১ জুলাই থেকে এইচএসসির নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার কথা। পরীক্ষা শেষ না হলে সেটাও শুরু করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। আর যদি চার মাস কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকে, তাহলে এর প্রত্যক্ষ শিকার হবে আরো প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী।
অবস্থা না পাল্টালে এইচএসসি পরীক্ষায় লাগবে চার মাস
এদিকে হরতালের কারণে পরীক্ষার সময়সূচি এলোমেলো হয়ে পড়ার আশঙ্কায় ভুগছে এইচএসি পরীক্ষার্থীরা। উদ্বিগ্ন তাদের অভিভাবকরাও। সময়সূচি ঠিক না থাকলে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া জটিল হয়ে পড়ে বলে জানায় তারা। এমনিতেই হরতাল-অবরোধের কারণে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে নানা সমস্যা হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীই মডেল টেস্টসহ শেষ সময়ের প্রস্তুতি নিতে শিক্ষকদের কাছে যেতে পারেনি। পরীক্ষার রুটিন পেলেও চলমান এসএসসি পরীক্ষার অবস্থার কথা ভেবে কোন বিষয়ের প্রস্তুতি কিভাবে নেবে সেটা ঠিক করতে পারছে না তারা।
রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এইচএসি পরীক্ষার্থী মো. ইমন বলল, ‘কোন বিষয়টির প্রস্তুতি নেব সেটাই বড় সমস্যা। রুটিন অনুযায়ী প্রস্তুতি নিলে তো হবে না। এখন যদি একটি বিষয় পড়ি দেখা গেল হরতালের কারণে ওই বিষয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে গেল, তাহলে এখন পড়ার কোনো মূল্য রইল না। খুবই টেনশনে আছি।’
ইমনের বাবা রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আসলে বলার তো কিছু নেই। এসএসসির বাচ্চারা যদি ছাড় না পায় এইচএসসিও যে ছাড় পাবে না সেটা নিশ্চিত। আর এইচএসসি পরীক্ষার ফলের ওপরই নির্ভর করবে উচ্চশিক্ষায় সে কোনদিকে যাবে। এভাবে যদি হরতাল-অবরোধের মধ্যে পরীক্ষা হয় তাহলে বাচ্চাদের ফলাফলেও এর প্রভাব পড়বে। তাহলে আমাদের সারা জীবনের পরিশ্রমের কী মূল্য রইল?’
নটর ডেম কলেজের পরীক্ষার্থী অর্নবের বাবা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘খালেদা জিয়ার যেদিন সংবাদ সম্মেলন হয় সেদিন আমার ছেলে পুরোটাই শুনেছে। ওর ধারণা ছিল হয়তো পরীক্ষার্থীদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আসবে। কিন্তু তেমন কিছু না হওয়ায় সে পুরোপুরি হতাশ। বাচ্চাদের এখন পরীক্ষার প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক কর্মসূচি দুই ধরনের চাপ নিতে হচ্ছে। একজন পরীক্ষার্থীর পক্ষে এ ধরনের চাপ বহন করাটা খুবই কষ্টকর।’
নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা হওয়াটাই আমাদের প্রত্যাশা। সেটা না হলে মানসিকভাবে ওদের বাধা সৃষ্টি হবে। শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় আছে। ১ এপ্রিল থেকেই পরীক্ষা শুরু হবে- শিক্ষামন্ত্রীর এমন ঘোষণার পরও কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। এইচএসসি পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার সময়সূচি যদি এলোমেলো হয়ে যায় তাহলে ফলাফলে এর কিছু না কিছু প্রভাব থাকবেই।’
উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ড. উম্মে সালেমা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন ঘরে ঘরে টেনশন। এইচএসসি পরীক্ষা পেছালে অন্য সব শিক্ষাকার্যক্রমও পেছাতে হবে। আসলে এখন আমাদের বলার কিছু নেই। বলবই বা কাকে? আর বললেও কি কেউ কিছু শুনবে? আমরা আসলে এখন প্রচণ্ড হতাশ।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যথাসময়ে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে না পারলে ফল পিছিয়ে যাবে। আমরাও ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারব না। তবে এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রীর অনুরোধে তাদের মন গলছে না।’ তবে পরিস্থিতি এখন যেমন আছে তাতে হরতালের মধ্যেও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন ইউজিসি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। এইচএসসির মধ্যেও এ ধরনের কর্মসূচি চললে সাহস করে পরীক্ষাটা নিয়ে নিলেই হয়। কারণ স্কুলের চেয়ে কলেজের শিক্ষার্থীরা আরেকটু ম্যাচিউরড। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অভিভাবকরা যদি দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যবস্থা নেন তাহলে কোনো দুষ্কৃতকারীরা শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করার সাহস পাবে না। এভাবে অনির্দিষ্টকাল ধরে চলা হরতাল-অবরোধে আমরা আর কত অপেক্ষা করব? যতই বাধা আসুক তা সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।’
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক কাজী ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে যে হরতাল-অবরোধ চলছে তা অবর্ণনীয়, অচিন্তনীয়। অর্ধশতাব্দী পর আমরা একটি একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। কিন্তু তা এখন ধ্বংস হওয়ার পথে। আমাদের তরুণ সমাজ বিশেষ করে পরীক্ষার্থীরাই যদি ধ্বংসের মুখে পড়ে এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলো কি এমন কোনো কর্মসূচি দিতে পারে না, যাতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত না হয়? আমি রাজনীতিবিদদের বলব, শিক্ষা নিয়ে কখনো রাজনীতি করবেন না। অনেক হয়েছে, এবার ক্ষ্যান্ত দিন।’
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, তারা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছে ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে আনতে। গত দুই-তিন বছরে কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছে। গত বছর ১৩ আগস্ট এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশের পরপরই ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এরপর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। আর যদি এইচএসসি পরীক্ষা জুলাই মাসে শেষ হয় তাহলে ফল দিতে হবে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ। এর পরই শুরু করতে হবে ভর্তি পরীক্ষা। এতে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃষ্টি হবে সেশনজট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্তই আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি। বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মূল ধারার শিক্ষা বিপর্যস্ত হবে। দেশটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মজীবন জড়িত। এই পরীক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুরুর জায়গাটাতেই হোঁচট খাবে শিক্ষার্থীরা।’
অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নীপা সুলতানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরীক্ষার পুরোটা সময় একনাগাড়ে হরতাল-অবরোধ আমরা আগে দেখিনি। এতে একটা বাচ্চা কী শিখছে? রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের এখন আর আহ্বানের কিছুই নেই। আমরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। আমাদের বাচ্চাদের জন্য ন্যূনতম চিন্তাভাবনা থাকলে তারা পরীক্ষার মধ্যে এভাবে হরতাল-অবরোধ দিতে পারত না।’
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘মার্চের মধ্যে এসএসসি ও সমমানের লিখিত পরীক্ষা শেষ করে ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হবে। এ ছাড়া আমাদের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।’ তিনিও স্বীকার করে বলেন, ‘হরতালের কারণে পরীক্ষা পেছালে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দেয়। এভাবে হরতাল চললে শিক্ষার্থীরা যোগ্য নেতৃত্বগুণ নিয়ে বড় হতে পারবে না। এতে দেশ ও জাতি বিরাট ক্ষতির মুখে পড়বে। আশা করি বিষয়টি উপলব্ধি করে পরীক্ষার মাঝে হরতাল-অবরোধের মতো কোনো কর্মসূচি দেবে না বিএনপি জোট।’
Leave a Reply