ডেইলি চিরন্তনঃ সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.) এর দরগাহে বার্ষিক উরস উপলক্ষে লৌকিক উৎসব ‘লাকড়ি তোড়া’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবছর দরগাহের বার্ষিক ওরসের তিন সপ্তাহ আগে- প্রায় ৭০০ বছর ধরে প্রচলিত লাকড়ি সংগ্রহের এ উৎসব পালিত হয়।
শুক্রবার ভিন্নভাবে ‘লাকড়ি তোড়া উৎসবে’ দরগাহ থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে লাক্কাতুরা চা-বাগানের জঙ্গল থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করেন শাহজালাল (রহ.) ভক্ত আশেকানরা। জুমার নামাজের পর হযরত শাহজালাল (রহ.) ভক্তবৃন্দ বিচ্ছিন্নভাবে একা একা পায়ে হেটে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ‘লাকড়ি তোড়া’ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। পরে লাকড়ি তোলে ওরসের জন্য শাহজালাল (রহ.) মাজারে এনে রাখেন। অথচ প্রতি বছর ‘লাকড়ি তোড়া’ উৎসবে ভক্ত আশিকানরা মিছিল সহকারে অংশগ্রহণ করতেন। এ সময় শাহজালাল (রহ.) মাজার থেকে মালনীছড়া পর্যন্ত দীর্ঘ যানঝট থাকতো। কিন্তু এবারই ভিন্ন আঙ্গিকে পালন হলো ৭০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব।
প্রতি বছর ২৬ শাওয়াল জোহর নামাজ শেষ হতেই বেজে ওঠে ঐতিহ্যবাহী ‘নাকাড়া’। ‘শাহজালাল বাবা কী জয়’, ‘৩৬০ আউলিয়া কী জয়,’ ‘লালে লাল শাহজালাল’ শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সিলেট নগরী। নাঙ্গা তলোয়ার, দা-কুড়াল ও লাল-ঝান্ডা হাতে হাজার হাজার শাহজালাল ভক্ত সকাল থেকেই খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে শাহজালাল দরগা প্রাঙ্গনে জমায়েত হতে থাকে। কেউ একা আসে-কেউ আসে প্রতিবেশী আশেকানদের সাথে। বিভিন্ন মাজার-খানকা ও গঞ্জ-গ্রাম থেকে দুপুরের নামাজ পর্যন্ত চলে ভক্তদের জমায়েত পর্ব। জোহরের নামাজ শেষ হতেই শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ‘নাকাড়া’ বেজে ওঠে। বেজে ওঠে ভক্ত-আশেকানদের শত শত ঢোল-ডঙ্কা।
বিভিন্ন কাফেলার সাথে আসা অসংক্ষ্য ব্যন্ড-পার্টির বাদ্যের তালে তালে চলে হাজার মানুষের শ্লোগানে শ্লোগানে নগ্ন পায়ে ছুটে চলা বেশির ভাগ মানুষের অঙ্গে থাকে লাল কাপড়। অনেকেই মাথায় লালপট্টি বাঁধে। এই মিছিল ছুটে চলে হযরত শাহজালাল (রহ.) এর ঐতিহ্যবাহী লাকড়ী তোড়া বা লাকড়ী ভাঙ্গার উৎসবে। সেখানে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠানের পর লাকড়ি নিয়ে দরগাহ শরীফে ফিরে আসেন ।
দরগাহ’র মোতাওয়ালি জানান, শাহজালাল (রহ.) এর জীবদ্দশায় এভাবে লাকড়ি সংগ্রহ করে রান্না করা হতো। সেই ঐতিহ্য রক্ষা করে ৭০০ বছর ধরে উরসের তিন সপ্তাহ আগে লাকড়ি তোড়া সম্পন্ন হয়ে আসছে। এসব সংগ্রহ করা লাকড়ি নির্দ্দিষ্ট স্থানে জমা করে রাখা হয়। আর এসব লাকড়ি দিয়েই উরসে শিরনির রান্না করা হয়ে থাকে।
দরগাহর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান মকন মিয়া জানান, করোনাভাইরাসের কারণে এবার সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে। শাহজালালের ভক্ত আশিকানরা লাকড়ি ভাঙ্গা উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন। আর তিন সপ্তাহ পরই অনুষ্ঠিত হবে পবিত্র ওরস মোবারক।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ৭০০ বছর আগে সিলেট বিজয় দিবসের কয়েক দিন ২৬ শাওয়ালের এই দিনের আগে এক কাঠুরে আসেন হযরত শাহজালাল (রহ.) এর কাছে। কাঠুরে জানান-ঘরে তার বিবাহযোগ্য ৫ মেয়ে রয়েছে। সে কাঠুরে নিচু জাতের হওয়ায় কেউই তার মেয়েদের বিয়ে করতে চাইছে না। এ কথা শুনে শাহজালাল (রহ.) কাঠুরেকে সিলেট বিজয় দিবসে দরগায় আসার কথা বলেন।
পরবর্তী সিলেট বিজয় দিবসে সঙ্গী আউলিয়া, ভক্ত ও আশেকানরা আসলে শাহজালাল (রহ.) সবাইকে নিয়ে লাক্কাতুড়া বাগানে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করেন। ফিরে এসে তিনি উপস্থিত ভক্তদের কাছে জানতে চান তারা আজ কি কাজ করেছে। উত্তরে সবাই বলেন তারা আজ কাঠুরিয়ার কাজ করেছে।
এরপর শাহজালাল সবাইকে কাঠুরের দুঃখের কথা বললে উপস্থিত অনেক ভক্ত কাঠুরের মেয়েদের বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেখান থেকে কাঠুরে তার মেয়েদের জন্য বর পছন্দ করেন। এ ঘটনার পর থেকে সাম্য ও শ্রেণী বৈষম্য বিরোধী দিবস হিসেবেও দিনটি পালন করেন ভক্তরা।
Leave a Reply