প্রতারণার নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদ ওরফে শহীদ। তার প্রতারণার শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। বাদ যায়নি শাশুড়িও। শাশুড়ির ব্যাংক হিসাব থেকেও প্রতারণা করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সাহেদ। এদিকে প্রতারণার জাল বিস্তার করে ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন তিনি।
নিজের ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য গোপন করেই সিলেটের মেয়ে সাদিয়া আরাবি রিম্মির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন সাহেদ। একপর্যায়ে তাকে বিয়ে করেন তিনি। রিম্মির মা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কয়েক বছর আগেই তিনি মারা যান। রিম্মিকে বিয়ে করার পর শাশুড়ির বিশ্বস্ততা অর্জন করেন তিনি। একপর্যায়ে শাশুড়ির ব্যাংক হিসাব থেকেও প্রতারণা করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সাহেদ।
সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমায় শাহেদের শ্বশুরবাড়ি। সূত্রমতে শাহেদের শাশুড়ি ঢাকার বনানীতে থাকতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। শাহেদ রিম্মিকে বিয়ে করার পর শাশুড়ির কাজকর্মে সহযোগিতা করতেন। দলীয় প্রভাব ও নিজের বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে সহজেই শাশুড়ির আস্থা অর্জন করেন। একপর্যায়ে শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে থাকা কোটি টাকার প্রতি লোভ জন্মে তার। নিজের ব্যবসার প্রয়োজনের কথা বলে এক সপ্তাহের জন্য টাকা ধার নেন শাহেদ। তারপর আর ফেরত দেননি ওই টাকা। এ নিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।
এদিকে হাসপাতাল করার নামে একাধিক ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেননি। চেক জালিয়াতি করে এসব ঋণ নিয়েছেন তিনি। ব্যাংকের কর্মকর্তারা ঋণের টাকা ফেরত চাইলে ক্ষমতার প্রভাব দেখাতেন। অর্থঋণ আদালতে সাহেদের বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতি, চেক ডিসঅনারের কয়েকটি মামলা রয়েছে। তবে প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও তাকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। বেসরকারি এনআরবি ও পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা জাল চেক দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন সাহেদ। দুটি ব্যাংকের পক্ষ থেকেই সাহেদের নামে মামলা করা হয়েছে। শুধু ঋণ নিয়ে নয় ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ নিয়ে তাও পরিশোধ করেননি সাহেদ।
জানা গেছে, রিজেন্ট গ্রুপের মালিক মো. সাহেদ রিজেন্ট হাসপাতালের যন্ত্রাংশ কেনার নামে এনআরবি ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে ২০১৪ সালে দুই কোটি টাকা ঋণ নেন। কিন্তু সেই টাকা এখনো পরিশোধ করেননি আলোচিত এই ব্যক্তি। ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যাংকের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো অর্থ পরিশোধ করেননি। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সাহেদের দেওয়া চেক জমা দিলে তা ডিসঅনার হয়। এনআরবি ব্যাংক ঋণের টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে অর্থঋণ মামলা করেছে। এ ছাড়া তার জামানত চেক ডিজঅনার হওয়ায় রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের বিরুদ্ধে এন আই অ্যাক্টের অধীনে ২টি মামলা করা হয়েছে অর্থঋণ আদালতে। মামলার বিবরণ-(১) অর্থঋণ মামলার নম্বর ১০/২০১৮, মামলায় জড়িত অর্থ- ১.৫২ কোটি টাকা (২) এন আই অ্যাক্টের মামলা-১৫০৩/২০১৬, মামলায় জড়িত অর্থ- ১.০০ কোটি টাকা (৩) এন আই অ্যাক্টের মামলা-১৭১২/২০১৭, মামলায় জড়িত অর্থ- ১.০০ কোটি টাকা এ ছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের ক্রেডিট কার্ডের জন্য অর্থঋণ মামলা নম্বর ১০০/২০২০ (টাকা ৪.৭৭ লাখ টাকা) দায়ের করা হয়েছে। পদ্মা ব্যাংক থেকে একই প্রকল্পে ঋণ নেন সাহেদ। এই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা ঋণ নেন জালিয়াতি করে। জানা গেছে, তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংক থেকে এক পরিচালকের যোগসাজশে সাহেদ আরেকটি ব্যাংকে ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও ২০১৭ সালে এই ঋণ নেন। ব্যক্তিগত এবং পরিবারের সদস্য ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের নামও জামানতের তালিকায় ছিল। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের নথি, চেক এবং আরজেএসসি লাইসেন্স আমলে নেয় সাবেক ফারমার্স ব্যাংক। হাসপাতালের জন্য একটি এমআরআই যন্ত্র কেনার জন্য এ ঋণ পাস হয়। ঋণ নিয়ে আর ব্যাংকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি তিনি। কর্মকর্তারা ঋণ আদায়ের জন্য চাপ দিলে তিনি নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে তা ঠেকিয়ে রাখেন। এসব ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহেদ যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছেন সব ছিল ভুয়া। এমনকি নিজের এনআইডি কার্ড জালিয়াতি করে ভুয়া কার্ড জমা দেন। ২০১৪ সালে এনআইডি কার্ড যাচাই করার ব্যবস্থা ছিল না ব্যাংকগুলোর।
পরে যখন কার্ড কর্তৃপক্ষ এনআইডি কার্ড যাচাই করার সুযোগ দেয় তখন ব্যাংক ভুয়া আইডি কার্ডের প্রমাণ পায়। পদ্মা ব্যাংক সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের এক পরিচালকের সঙ্গে যোগসাজশে দুই কোটি টাকার পুরোটাই নেওয়া জাল জালিয়াতির কাগজপত্র দিয়ে। পরবর্তীতে ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন হলে ব্যাংক সাহেদকে খুঁজে বের করে রিজেন্ট হাসপাতালে হানা দেয়। ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রথমে সাহেদ স্বীকার করতে চাননি কোনো ঋণের কথা। পরবর্তীতে তাকে চাপ দিলে তিনি স্বীকার করেন এবং টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে ওই প্রতিশ্রুতি পর্যন্তই। পরবর্তীতে উল্টো ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। পরে ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়। জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থানা পরিচালক এহসান খসরু বলেন, ২০১৭ সালে সাহেদ ও রিজেন্টের আরেক পরিচালক ইব্রাহিম খলিলের নামে মামলা হয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও কৌশলে তারা গ্রেফতার এড়ায়। ব্যাংক এখনো টাকা ফেরত আনতে পারেনি।
Leave a Reply