তাজমহলের ভেতর-বাইরের সৌন্দর্যের খবর কম-বেশি অনেকেই জানেন। কিন্তু এর নির্মাণের পেছনে আরও অনেক বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় ২৪০ ফুট উচ্চতা নিয়ে প্রায় ৪০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র তাজমহল। ১৯৮৩ সালে সপ্তমবারের মতো ডিজাইন বদল করা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের এ ভবন যমুনা নদীর ওপর স্থির দণ্ডায়মান- এ তো আরেক বিস্ময়! স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতি ধরে রাখতে যে সৌন্দর্য সম্রাট শাহজাহান ভারতবাসীকে তাজমহলের মাধ্যমে উপহার দিয়ে গেছেন- সেই সৌন্দর্যকে সম্রাট নিজে যে মনভরে উপভোগ করতে পেরেছেন, তা কিন্তু নয়। কারণ ১৬৫৮ সালে ছেলে আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে বন্দি করে ক্ষমতা দখল করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাজমহলের পাশে আগ্রার লাল কেল্লায় বন্দি থেকে শুধু সেই ভবনের বাইরের সৌন্দর্যই উপভোগ করতে পেরেছিলেন মাত্র। শাহজাহান মৃত্যুবরণ করেন ১৬৬৬ সালে। তাকে কেন ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল? তাজমহল নির্মাণে সরকারি কোষাগার শূন্য হয়ে পড়ায় রাষ্ট্র পরিচালনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এটা অনুধাবন করে বাধ্য হয়ে আওরঙ্গজেব তার বাবাকে মসনদ থেকে হটিয়ে দিতে বাধ্য হন। তার মানে, তাজমহল নির্মাণের কারণেই শাহজাহানকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল। এ তাজমহলের ভেতর-বাইরে যত না চমক, তার চেয়ে বেশি এটা নির্মাণের নেপথ্য ঘটনায়। কথিত আছে, এ ভবনের স্থাপত্য নকশা নির্মাণ করেছিলেন যারা- তাদের প্রত্যেকের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল, যেন তারা এ রকম আরেকটি ভবনের নকশা তৈরি করতে না পারেন। ১৬৩২ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ১৬৫৩ সালে। এ ভবনের প্রধান স্থপতি ছিলেন ওস্তাদ আহমেদ লাহৌরি। তার সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন ২০ হাজার শ্রমিকের ঘাম ঝরেছিল এটির নির্মাণে। এক হাজার হাতি মালামাল বহনে ব্যবহার করা হয়েছিল। দামি সব পাথর ব্যবহৃত হয়েছিল এর সৌন্দর্য বর্ধনে- আকিক, ইয়েমেনি, ফিরোজা, কোরাল, সোলায়মানি, ক্যাটস আই, ব্লাড স্টোন ইত্যাদি। অন্যান্য পাথর তো ছিলই। নদীর ওপর নির্মিত হচ্ছিল বলে এর ভিত্তিতে ব্যবহার করা হয়েছিল ১৬০ ফুট লম্বা কয়েক হাজার পাইল। নদীর কিনারায় ইট, পাথরসহ অন্য মালামাল আনার জন্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার পাথরের রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। পাইলিংয়ের আশপাশের এলাকা ভরাট করা হয়েছিল পাথর পিটিয়ে। এরপর বসানো হয়েছিল ইট। সেই সময়ে এর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ৩২ মিলিয়ন রুপি। সাদা মার্বেল আনা হয়েছিল মাক্রানা আর রাজস্থান থেকে, লাল-হলুদ-বাদামি পাথর পাঞ্জাব থেকে, সবুজ ও স্বচ্ছ পাথর আনা হয় চীন থেকে। ব্যবহৃত ২৮ রকমের অন্য পাথরগুলো আনা হয় তিব্বত, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা ও আরব থেকে। তাজমহলের ভেতরের ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য শিল্পী আনা হয়েছিল বুখারা থেকে এবং ক্যালিগ্রাফারদের সিরিয়া ও পারস্য থেকে। উল্লেখ্য, এর বিভিন্ন অংশে পবিত্র কোরআনের ১৫টি সুরার ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছিল। ক্যালিগ্রাফার আব্দ উল হক নানা রঙের পাথরে এসব ক্যালিগ্রাফি নির্মাণ করেছিলেন। স্ত্রীকে ভালবেসে যে সৌন্দর্য নির্মাণ করে শাহজাহান নিঃস্ব করেছিলেন রাজকোষাগারকে, তিনিই আবার নিঃশেষ হলেন তার খেসারত দিতে গিয়ে- পৃথিবীর ইতিহাসে এমন হৃদয়বিদারক পরিণতির ঘটনা আর দ্বিতীয়টি ঘটেছে বলে শোনা যায়নি।
Leave a Reply