ডেইলি চিরন্তনঃ গতকাল দুপুর তখন ১টা। জৈন্তাপুর সদর। বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ফাহিমা আক্তার হেনা বাড়ি যাওয়ার জন্য টমটমে ওঠে। প্রথমে টমটমে এক মহিলা বসা ছিল। স্কুলছাত্রী হেনা টমটমে ওঠার পর আরেক বোরকা পরা মহিলা টমটমে ওঠে। গাড়ির সিটে হেনার অবস্থান হয় দুই মহিলার মধ্যখানে। এরপর টমটম জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সদর থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে কদমখালের বিরাইমারা গ্রামে হেনার বাড়ি। কাছাকাছি আসার আগে দু’পাশে বসা দুই মহিলার একজন হেনাকে একটি কাগজ পড়ার জন্য দেয়। হেনা এতে রাজি হয়নি।
এরপর তার মুখে রুমাল চেপে ধরতে যায় এক মহিলা। এ সময় হেনা ধস্তাধস্তি শুরু করে। একপর্যায়ে হেনা সড়কে লুটে পড়ে অপহরক চক্রের কবল থেকে রক্ষা পায়। পরে স্থানীয় লোকজন হেনাকে উদ্ধার করে জৈন্তাপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন। হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় হেনা জানায়- ‘ওই মহিলার পরনে বোরকা ছিল। তাদের চিনতে পারেনি।’ জৈন্তাপুর সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা। পাশেই ভারতের মেঘালয়। পরপর কয়েকটি অপহরণের ঘটনায় গোটা জৈন্তাপুরে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে স্কুল কলেজের ছাত্রী এবং তাদের পরিবারের মধ্যে এই আতঙ্ক জেঁকে বসেছে। এমন ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি। শুধু হেনাই নয়; সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে জৈন্তাপুরে। জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর আহমদ ‘ওসি জৈন্তাপুর’ ফেসবুক আইডিতে বুধবার এক পোস্টের মাধ্যমে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরপর গতকাল দুপুরে শিক্ষার্থী হেনার ঘটনা আতঙ্কিত করে দিয়েছে সবাইকে। ডিবিসহ পুলিশের অন্তত ৭টি টিম অপহরণকারী চক্রের সন্ধানে মাঠে নেমেছে। কেউ কেউ ধারণা করছেন, অপহরণ করে সীমান্ত দিয়ে স্কুলছাত্রীদের ভারতে পাচার করার জন্য এসব করা হচ্ছে। তবে- এ ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বুধবার ওসি জৈন্তাপুর তার ফেসবুক আইডিতে সতর্কবার্তা দিয়ে জানান, ‘একটি অপহরণকারী চক্র জৈন্তাপুর থানা এলাকায় অবস্থান করছে। পুরুষ ও মহিলা নিয়ে চক্রটি গঠিত। তাদের টার্গেট স্কুল, কলেজের মেয়েদের অপহরণ করে পাচার করে দেয়া। এমতাবস্থায় স্কুল, কলেজের সম্মানিত শিক্ষকগণকে এই ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের সতর্ক করার অনুরোধ জানাচ্ছি। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী স্কুল, কলেজগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আমাদের পুলিশিং তৎপরতা অব্যাহত আছে। এই ব্যাপারে জৈন্তাপুর মডেল থানা পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য জৈন্তাপুরবাসীকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’ ওসির এই বার্তার পর জৈন্তাপুরের মানুষ অপহরণ চক্রের ব্যাপারে সতর্ক হয়েছেন। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে গেছে শিক্ষার্থী হেনার ঘটনা। উদ্ধার হওয়ার পর হেনাকে জৈন্তাপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কদমখালের বিরাইমারা গ্রাম থেকে তার পিতা-মাতা সেখানে ছুটে যান। এ সময় হেনা তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেন।
অপহরণ চক্রের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে হাতে ও পায়ে জখম হয়েছে হেনার। চিকিৎসা শেষে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে, ভড়কে গেছে সে। এ ঘটনায় আতঙ্কিত পরিবারও। হেনার পিতা আব্দুল জলিলসহ পরিবারের সদস্যরা জানান, ‘ছায়া প্রতিদিনই বাড়ি থেকে টমটম যোগে জৈন্তাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যায়।
টমটমে করে আবার ফিরেও আসে। অতীতে কখনোই এমন ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার পর থেকে তারা আতঙ্কে আছেন বলে জানান।’ এদিকে, এর আগে গত মঙ্গলবার সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী ফান্দু গ্রামের মারুফা বেগম অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা দিতে বাড়ি থেকে বের হয়। এ সময় অপহরণকারী চক্রের দুই মহিলা মারুফাকে একটি কাগজ পড়ে দিতে বলে। কাগজ হাতে নিয়ে পড়ার আগেই দুই মহিলা কাগজটি মেয়েটির মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে টমটমে ছাত্রীটিকে তুলে নেয়। পরে ছৈয়া এলাকায় পৌঁছলে ছাত্রীটি ধস্তাধস্তি করে টমটম গাড়ি হতে লাফ দিয়ে পড়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। অপরদিকে ২৯শে শে মে সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী বাড়ি হতে বের হয়ে বিদ্যালয়ে আসার পথে নিখোঁজ হয়। একইভাবে ২০শে মে চিকনাগুল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী স্কুল হতে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয়।
দুটি মেয়ের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি; তারা নিখোঁজ রয়েছে। তাদের পরিবারের পক্ষ হতে থানায় নিখোঁজের জিডি করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার ছাত্রী অপহরণের ঘটনার চেষ্টার পর হতে জৈন্তাপুর থানা পুলিশ বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সকল ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৬টি ইউনিয়ন পরিষদসহ পাড়া মহল্লার মসজিদ, মন্দির, হাটবাজারে সর্তকবার্তা জারি করা হয়। সেইসঙ্গে অপহরণকারীদের ধরিয়ে দিতে সচেতন মহলকে আহ্বান করা হয়। অভিভাবক ও শিক্ষক মহলকে শিক্ষর্থীরা বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের তরফ থেকে সর্তক থাকার আহ্বান জানানো হয়। জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর আহমদ জানিয়েছেন, দুটি বিদ্যালয়ের ছাত্রী নিখোঁজের পর অভিভাবকরা থানায় জিডি করেন। এর পরপর আরও দুটি ঘটনা ঘটে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে উপজেলাজুড়ে সর্তকতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সেইসঙ্গে অপহরণকারীকে ধরতে পুলিশ সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান জানান।সূত্র-মানবজমিন
Leave a Reply