ডেইলি চিরন্তনঃ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। সেখান থেকে নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তখন থেকেই বহির্বিশ্বেও সুনাম কুড়িয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। তবু সদ্য পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। পেয়েছিলেন সাজাও। ছাত্রদের গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই মুহাম্মদ ইউনূসই এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর হাতেই দেশ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব।
বিগত ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারানোসহ বিভিন্ন মামলায় আদালতে বারবার হাজিরা দিতে হয় নোবেলবিজয়ী ইউনূসকে। গ্রেপ্তারের আশঙ্কায়ও ছিলেন তিনি। সর্বশেষ শ্রম আদালত মুহাম্মদ ইউনূসকে ছয় মাসের কারাদ- দেয়। গত বুধবার একই আদালত মুহাম্মদ ইউনূসের কারাদ- বাতিল করে।
জাতীয়
নোবেল বিজয়ী থেকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান
অপূর্ব কুমার
প্রকাশিত: ০০:২৬, ৯ আগস্ট ২০২৪
FacebookTwitterEmailWhatsAppLinkedInMessengerShare
নোবেল বিজয়ী থেকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান
ড. মুহাম্মদ ইউনূস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। সেখান থেকে নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তখন থেকেই বহির্বিশ্বেও সুনাম কুড়িয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। তবু সদ্য পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। পেয়েছিলেন সাজাও। ছাত্রদের গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই মুহাম্মদ ইউনূসই এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর হাতেই দেশ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব।
বিগত ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারানোসহ বিভিন্ন মামলায় আদালতে বারবার হাজিরা দিতে হয় নোবেলবিজয়ী ইউনূসকে। গ্রেপ্তারের আশঙ্কায়ও ছিলেন তিনি। সর্বশেষ শ্রম আদালত মুহাম্মদ ইউনূসকে ছয় মাসের কারাদ- দেয়। গত বুধবার একই আদালত মুহাম্মদ ইউনূসের কারাদ- বাতিল করে।
Play Video
গত ২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তখন একইসঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকও পেয়েছিল নোবেল পুরস্কার। অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার অর্জন করায় সে সময় বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ সবার আগেই শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে থাকে দলটি।
যার প্রথমটা শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে নোবেলবিজয়ী ইউনূসকে অব্যাহতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। ২০১১ সালের ২ মার্চ গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে মুহাম্মদ ইউনূসকে অব্যাহতি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ জারি করে।
এর বিরুদ্ধে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নয়জন পরিচালক দুটি রিট মামলা করেছিলেন। দুটি রিট আবেদনই খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্ট ড. ইউনূসকে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশ বহাল রাখে। পরে ওই বছরের ১২ মে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইস্তফা দেন অধ্যাপক ইউনূস। ক্ষমতায় আসার পরই পদ্মা সেতু তৈরিতে প্রকল্প প্রস্তুত করে বাংলাদেশ। ওই সময় অর্থায়নে রাজিও হয় বিশ্ব ব্যাংক।
কিন্তু মাঝপথে সেই অর্থায়ন আটকে যায় দুর্নীতির অভিযোগে। এর পর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে শেখ হাসিনা অভিযোগ তোলেন ড. ইউনূস প্রভাবিত করার কারণেই আটকে গিয়েছিল পদ্মা সেতুর অর্থায়ন।
গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু ॥ দেশের বাইরে পড়াশোনা শেষে ইউনূস প্রথমে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গণমাধ্যমকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, নতুন বিভাগ হওয়াতে তখন বিভাগে তেমন বেশি কোনো কাজ ছিল না। তিনি আশপাশের গ্রামে ঘুরতেন। সেখানকার মানুষের জন্য কিছু করতে চাইতেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘রুরাল ইকনোমিকস প্রোগ্রামের’ প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস তখন জোবরা এবং সংলগ্ন গ্রামগুলোতে শুরু করেছিলেন একটি মাঠ গবেষণা, যেখানে তিনি যাচাই করতে চেয়েছিলেন সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের মধ্যে ব্যাংক ঋণ সরবরাহের সম্ভাব্যতা। সেখানে শুরুতে তেভাগা-পদ্ধতি কৃষকদের খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমের কার্যক্রম শুরু করেন ইউনূস। যার নাম ছিল নবযুগ তেভাগা খামার।
ড. ইউনূস বলেন, ‘জমি যার সে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে। আর যে বীজ দেবে সার দেবে সে পাবে এক ভাগ। আর চাষ করবে, পানি দেবে সে পাবে এক ভাগ। এ রকম করে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম।’
পরে গ্রামের অবহেলিত নারী ও পুরুষদের নিয়ে একটা সমিতি শুরু করেন তিনি। সেই সমিতিতে সঞ্চয় করত সবাই। ওই কৃষকদের খামার থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি রচিত হয় ১৯৭৬ সালে।
পরবর্তীতে ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক জন্ম হয় গ্রামীণ ব্যাংকের।
গ্রামীণ ব্যাংক মূলত ভূমিহীন এবং দরিদ্র নারীদের পাঁচজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে এবং এ ঋণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্রদের রক্ষা করতে ব্যাংক অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ক্ষুদ্র ঋণের সঙ্গে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্পসহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব এমন কি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশসমূহকে গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এই কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করলে ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন অধ্যাপক ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক।
জোবরা গ্রাম থেকে নোবেল জয় ॥
চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামের সেই নবযুগ খামার থেকে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের। যেখান থেকে ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এর কার্যক্রম। ইউনূস সেই জোবরা গ্রামের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে জানিয়েছেন সে সময়কার কথা। তিনি জানান, তখন এই জোবরা গ্রামে বাস করত হতদরিদ্র অনেক মানুষ। কিন্তু তিনি অর্থনীতির শিক্ষক হয়েও সেসব মানুষের জন্য কিছু করতে না পারার আক্ষেপ ছিল তার। তিনি বলেন, তখন আমি ভাবলাম অযথা সময় নষ্ট করছি। এই অর্থনীতি দিয়ে আমি কি করব যা মানুষকে কোনো ধরনের উপকারে আসে না।’
আলোচিত সেই জোবরা গ্রামটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পাশে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শেষে প্রতিদিনই জোবরা গ্রামে যাওয়া শুরু করলেন অধ্যাপক ইউনূস। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করতেন। তখন কৃষিকাজের জন্য কোনো পানির ব্যবস্থা ছিল না ওই গ্রামে। ওই সময় বাংলাদেশে প্রথম আসে ইরি ধানের চাষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে জমিতে ইরি ধানের চাষ করার জন্য উদ্যোগ নিই। কিন্তু তখন সেখানকার বাসিন্দারা বললেন, সেখানে পানির সমস্যা। পরে টিউবয়েল বসিয়ে ইরি ধানের চাষ শুরুর ব্যবস্থা করেন।
তেভাগা পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন কৃষকদের নিয়ে। এখন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সেই সামাজিক ব্যবসার ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। যে সামাজিক ব্যবসা শুরু হয়েছিল সেই জোবরা গ্রাম থেকে। ড. ইউনূস বলেন, ‘এটি জোর করে কাউকে করতে হচ্ছে না। সরকারের হুকুম দিয়ে করতে হচ্ছে না। মানুষ সেটা পছন্দ করে আনন্দিত হয়ে করছে। বিশ্বের বিভিন্ন মানুষ এখন এই ধরনের সামাজিক ব্যবসায় নেমেছে।’
জন্ম ও বেড়ে ওঠা ॥ ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ পাস করেন।
পড়াশোনা শেষে তিনি ব্যুরো অব ইকোনমিক্স-এ যোগ দেন গবেষণা সহকারী হিসেবে। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। পরে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষুদ্রঋণের ধারণার মাধ্যমে সারাবিশ্বে একটি সাড়া ফেলে গ্রামীণ ব্যাংক।
Leave a Reply