সেই দরাজ কণ্ঠ আর জাদুকরী ধারাভাষ্য আর কখনোই শোনা যাবে না। মৃত্যুর শীতল স্পর্শে থেমে গেল ‘ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর’। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ও কিংবদন্তি ধারাভাষ্যকার রিচি বেনো আর নেই। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে ঘুমের মধ্যেই চিরঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বেনো। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। গত বছর নভেম্বর থেকে ত্বকের ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই চলছিল এই ক্রিকেট কিংবদন্তির। শুধু ক্রিকেটার হিসেবেই নয়। লেখক, কলামিস্ট ও ধারাভাষ্যকার হিসেবেও দারুণ সফল ছিলেন বেনো। বর্ণময় ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে মূলত ধারাভাষ্যকার হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। রেডিও ও টেলিভিশনে প্রাণবন্ত ধারাভাষ্যের জন্য তাকে বলা হতো ‘ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর’।
ধারাভাষ্যকার পরিচয়টি বাদ দিলেও শুধু ক্রিকেটার হিসেবেই সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবে তাকে মনে রাখবে ইতিহাস। নিজের প্রজন্মের সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন বেনো। লেগ স্পিন বোলিংয়ের এই অগ্রদূত ব্যাট হাতেও ছিলেন সফল। ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে দুই হাজার রান ও ২০০ উইকেটের ‘ডাবল’ কীর্তিটা তার। ১৯৬৪ সালে অবসর নেয়ার আগে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৬৩টি টেস্ট খেলেছেন বেনো, ২৮ ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হিসেবে কোনো টেস্ট সিরিজ হারেননি বেনো। তার নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া পাঁচটি সিরিজ জেতে ও দুটি ড্র করে।
টেস্ট ক্যারিয়ারে ২৪৮ উইকেটের পাশাপাশি তার ঝুলিতে আছে ২২০১ রান। এছাড়া ২৫৯টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে ৯৪৫ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ১১৭১৯ রান করেন তিনি। খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানার আগেই সাংবাদিকতা ও ব্রডকাস্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন বেনো। ১৯৫৬ সালে ইংল্যান্ডে অ্যাশেজ সিরিজের পর বিবিসির একটি কোর্স করেন। ১৯৬০ সালে বিসিসি রেডিওর হয়ে প্রথম ধারাভাষ্য দেন বেনো। তিন বছর পর আসেন টেলিভিশনে। ১৯৭৭ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার চ্যানেল নাইনের প্রধান ধারাভাষ্যকার ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে সিডনিতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন বেনো। এরপর ত্বকের ক্যান্সার ধরা পড়ায় আর ধারাভাষ্য দিতে পারেননি।
ক্রিকেটের এমন জনপ্রিয়, প্রভাবশালী ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, গোটা ক্রিকেট বিশ্বেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গভীর শোক প্রকাশ ও শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানানোর ঘোষণা দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বেনোর ব্রোঞ্জ মূর্তির বেদী ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। সিডনি হারবার ব্রিজসহ গোটা দেশে অর্ধনমিত রাখা হয়েছে পতাকা। প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট এক শোকবার্তায় জানিয়েছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার জন্য বড় শোকের দিন আজ। আমরা একজন ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন, কিংবদন্তি ও জাতীয় নায়ককে হারিয়েছি। কী অসাধারণ এক ইনিংস। শান্তিতে ঘুমান বেনো।’
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চেয়ারম্যান ওয়ালি এডওর্য়াডসের চোখে বেনো ছিলেন সত্যিকারের একজন কিংবদন্তি, ‘অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটির মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে ছিলেন তিনি। তাকে ছাড়া অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্ম কল্পনাও করতে পারছি না আমি। ডন ব্র্যাডম্যানের পর অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বকে হারালাম আমরা।’ সবার মনের কথাটা বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক, ‘তার কণ্ঠস্বর শুনেই বেড়ে উঠেছি আমরা। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ খেলোয়াড় ও নেতা। মাঠে ও মাঠের বাইরে মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি জিততে ভালোবাসতেন এবং জয়ের তীব্র ক্ষুধা অস্ট্রেলিয়া দলের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন।’ ভারতীয় ব্যাটিং গ্রেট শচীন টেন্ডুলকারও গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন বেনোকে, ‘ক্রিকেটের মুখ ছিলেন তিনি। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল ক্রিকেটের।’ শেন ওয়ার্নের চোখে, ‘বেনো ছিলেন আশার হিরো ও ক্রিকেটের গডফাদার। ক্রিকেট ধারাভাষ্যের মানদণ্ড তিনি।’ আরেক সাবেক অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ বলেছেন, ‘আরেকজন রিচি বেনো আর কখনোই আসবে না। তিনি ছিলেন অনন্য, ক্রিকেটের সব ক্ষেত্রেই ছিল তার পদচারণা। খেলোয়াড়, ধারাভাষ্যকার, প্রশাসক এবং লেখক- সব ভূমিকাতেই সফল বেনো। ক্রিকেটে তার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে
Leave a Reply