জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করায় সরকার সমর্থিত শত শত নেতাকর্মী উল্লাস করছেন বাংলাদেশে। ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে বিজয় প্রকাশ করছেন তারা। অন্যদিকে ফাঁসির ঘটনায় এমনিতেই অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। দেশের ভেতরে বিরোধী দল ও বিদেশের প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচার অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তুরস্ক। অন্যদিকে ফাঁসির ঘটনায় নজর রাখছে পাকিস্তান। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর আন্তর্জাতিক দুনিয়ার মিডিয়াগুলোতে এসব কথা বলা হয়েছে। এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) লিখেছে, শনিবার বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে পাকিস্তান বলেছে, ফাঁসির ঘটনায় তারা নজর রাখছে। লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান যেন কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা না হয়। তিনি বলেন, কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যে বিচার হয়েছে তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে না। অধিক আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তা সত্ত্বেও তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় ফাঁসি কার্যকর না করতে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেরি হার্ফ এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা অগ্রগতি দেখছি। তা সত্ত্বেও আমরা বিশ্বাস করি, মানের আরও উন্নয়ন করা হলে এই বিচার প্রক্রিয়া দেশ ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে পারতো। গার্ডিয়ানের রিপোর্টে আরও বলা হয়, এই ফাঁসির ফলে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে তা আরও ঘনীভূত হতে পারে। জামায়াতের কমপক্ষে ৫ জন নেতার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। তাদের আপিল সুপ্রিম কোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। গার্ডিয়ান আরও লিখেছে, কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করার পর দেশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ৬২ বছর বয়সী কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিরস্ত্র কমপক্ষে ১২০ কৃষককে হত্যা করেছেন। এ অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করেছে বিশেষ আদালত। ওই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে বলা হয়, যদিও এ সংখ্যা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে আপত্তি আছে। কামারুজ্জামানের ফাঁসিতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের ইমরান এইচ সরকার। তিনি বলেছেন, এই ফাঁসির মাধ্যমে আমাদের বিজয় হয়েছে। আমরা ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করেছি। আমাদের প্রত্যাশা আদালতের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এর আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে জামায়াতের আরেক নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়। ওদিকে ফাঁসি কার্যকর করার নিন্দা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তারা এই ফাঁসিকে ‘প্রতিশোধ ও পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছে। একই সঙ্গে আজ দেশজুড়ে হরতাল আহ্বান করেছে। এই বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন কড়া সমালোচনা করেছে। কামারুজ্জামানের আইনজীবী গার্ডিয়ানকে বলেছেন, এই বিচার মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ডেমোক্রেট গেজেট লিখেছে, ফাঁসি কার্যকরের পর কামারুজ্জামানের সমর্থকরা দেশজুড়ে হরতাল আহ্বান করেছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে সিনিয়র এক জেল কর্মকর্তা ফরমান আলী বলেছেন, শনিবার রাত সাড়ে দশটায় কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তার ফাঁসিতে উল্লাস প্রকাশ করছেন সরকার সমর্থকরা। এতে বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, সব আইনি ও ধর্মীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। আরব নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গণহত্যার দায়ে বাংলাদেশ সরকার শনিবার ফাঁসি কার্যকর করেছে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে রাত ১০টায়। জেলের চার প্রশিক্ষিত কয়েদি ফাঁসি কার্যকরে অংশ নেন। এ জন্য কামারুজ্জামানের সেলের কাছেই বানানো হয় ফাঁসির মঞ্চ। সেখানেই বাংলাদেশের জেল-এর নিয়মকানুন অনুসরণ করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন চিকিৎসক কামারুজ্জামানকে মৃত ঘোষণা করার মাধ্যমে শেষ হয় ফাঁসি। এর ফলে শত শত ধর্মনিরপেক্ষ নেতাকর্মী আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তারা বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শন করেন। শেষ মুহূর্তে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ফাঁসি স্থগিত করার আবেদন করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ফাঁসি কার্যকর করেছে। জাতিসংঘ বলেছে, এই বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হয় নি। ফাঁসি কার্যকর করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা কড়া নিরাপত্তার মাধ্যমে কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওদিকে আউটলুক ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, কামারুজ্জামানকে দাফন করা হয়েছে। তার সমর্থকরা আজ দেশজুড়ে হরতাল আহ্বান করেছে। গতকাল সকালে শেরজুর জেলার কুমরি মুদিপাড়ায় স্থানীয় সময় ৫টা ১০ মিনিটে নামাজে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। ফাঁসির পর নয়টি গাড়ির বহরে কামারুজ্জামানের লাশ শনিবার রাতেই নিয়ে যাওয়া হয়। এই গাড়ির বহরে ছিলেন এমন একজন সাংবাদিক বলেছেন, নিরাপত্তার অভিযোগে পুলিশ তাদেরকে কামারুজ্জামানের গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার আগে থামিয়ে দেয়।
Leave a Reply