আবুল হায়াত। কখনও বাবা, কখনও চাচা, আবার কখনও মামা। এসব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেই বেশ জনপ্রিয়। শুধু টিভি নাটকেই নয়, বেতার, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ অর্থাৎ সংস্কৃতি অঙ্গনের সব কয়টি মাধ্যমেই বিচরণ করছেন তিনি। ৭১ বছর বয়স হলেও এখনও চিরসবুজ। চার দশক ধরে অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত এ অভিনেতা। গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে সংযুক্ত নাগরিক নাট্য সমপ্রদায়ের অন্যতম সদস্য আবুল হায়াত। অভিনয়ের বাইরে লেখালেখি ও নির্মাণেও ব্যস্ত। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এখানেই শেষ নয়, আবুল হায়াত চলতি বছরে ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকে। এত অর্জন, জনপ্রিয়তা। লম্বা এই সময়ে এত কিছু পাওয়া কারও অনুপ্রেরণা আর অবদান ছাড়া সম্ভব হতো না নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, আবুল হায়াতকে পেছন থেকে যে মানুষটি প্রতিনিয়ত সাহস দিয়ে এসেছেন তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রী শিরিন হায়াত। আবুল হায়াত বলেন, আমার স্ত্রী শিরিনের অবদান অপরিসীম। তার শতভাগ সহযোগিতা না পেলে এতদূর আসতে পারতাম না। আমি চাকরিজীবী ছিলাম। থিয়েটারে একসময়-প্রচুর সময় দিয়েছি। আমি তখন সংসারকে অনেক বঞ্চিত করেছি। সব সামলে নিয়েছেন আমার প্রিয়তমা শিরিন। যে কারণে তার অবদান অনেক। পাশাপাশি মেয়েদেরও অবদান রয়েছে। ৪০ বছরের এই ক্যারিয়ারে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তালিকা অনেক দীর্ঘ আবুল হায়াতের। তবে যখন প্রাপ্তির পাল্লাটা বরাবরই ভারি থাকে তখন অপ্রাপ্তিগুলো ছাপিয়ে যায় নিমিষেই। এমনটাই বিশ্বাস করেন জনপ্রিয় এ অভিনেতা। আবুল হায়াত বলেন, অভিনয় জীবনের প্রাপ্তি হলো কাজ করে প্রচুর আনন্দ পেয়েছি। অনেক বন্ধু পেয়েছি এই জীবনে। অন্য পেশায় থাকলে পেতাম কিনা জানি না। অনেক ভাল মানুষের সঙ্গ পেয়েছি। আসলে আমার চাওয়াটা তো কম ছিল। সব সময় কম চেয়েছি। তাই আমার প্রাপ্তি অনেক বেশি। আর যেখানে প্রাপ্তিটা বেশি সেখানে অপ্রাপ্তিগুলো ছাপিয়ে যায়। আমি না পাওয়াটা নিয়ে কখনও আক্ষেপ করি না। পজিটিভটাই সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। চলার পথে মানুষের জীবনে কত স্মৃতি মনে পড়ে। সেসব যখন সামনে চলে আসে মানুষকে অনেক আবেগি করে তোলে। আর তেমনই আবেগের সুরে আবুল হায়াত তার অভিনয় জীবনের সেই স্মৃতিগুলোর বিবরণ দিলেন। তিনি বলেন, কত স্মৃতিই তো মনে পড়ে। তবে পেছনে ফিরে তাকালে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, দশ বছর বয়সে আমি জীবনের প্রথম অভিনয় করেছিলাম। নাটকটির নাম ছিল ‘টিপু সুলতান’। তখন চট্টগ্রামে থাকতাম। তখনই হয়তো ভাগ্যে লেখা হয়ে গিয়েছিল আমি অভিনয় করবো। বাবার চাকরির সুবাদে আমার পড়াশোনা ও যৌবনকাল চট্টগ্রামে
কেটেছে। চট্টগ্রামে কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। সেখানকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহু পুরনো। অনেকটা সময়জুড়ে চট্টগ্রামে বসবাস করেছি বলেই কেউ কেউ মনে করেন আমি চাটগাঁইয়্যা। অবশ্যই চট্টগ্রামের স্মৃতি কখনও ভোলা যাবে না। আর তাই সেখানে সুযোগ পেলেই চলে যাই। ১৯৬২ সালে আমি ঢাকায় আসি। তখন আমি বুয়েটে পড়ি। জীবনে ঢাকায় এসে প্রথম নাটকের নাম ‘এক মুঠো আকাশ’। এখনও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই দিনটির কথা। কত আয়োজন, কত আকাঙ্ক্ষাই না কাজ করেছিল সেদিন। ১৯৬৯ সালে ‘ইডিপাস’ নাটকের মাধ্যমে টিভি পর্দায় যাত্রা শুরু করেন আবুল হায়াত। তখন এখনকার মতো এত উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। ভাল ক্যামেরাও ছিল না। আর সেসব কথা বলতে গিয়ে আবুল হায়াত বলেন, আমাদের সময় নাটকে বা চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য এত উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। ভাল ক্যামেরার ব্যবহারও ছিল না। আমি, আতাউর রহমান, আলী যাকেররা যখন কাজ শুরু করি তখন অনেক কষ্ট করে কাজ করতাম। তবে আমরা যে কাজগুলো করতাম সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম। আমরা যখন কাজ করেছি প্রতিযোগিতাও তেমন ছিল না। এখন তো অনেক প্রতিযোগিতা। নাটক হচ্ছে প্রচুর। শিল্পীর সংখ্যাও বেড়েছে। বেড়েছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। টিভি নাটক যা হচ্ছে খারাপ হচ্ছে না। ভালই করছেন সবাই। এখন তো অনেক টিভি চ্যানেল। সে জায়গায় নাটকও প্রচুর নির্মাণ হচ্ছে। তাই বলা যায়, খারাপ কিছু কাজ থাকলেও সেই সঙ্গে ভালটাও হচ্ছে। আর অনেক কাজের মধ্যে ভাল-মন্দ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই সময়ে শোবিজে অনেক তারকার আবির্ভাব ঘটেছে। আবুল হায়াত তাদের নিয়ে মোটেও অসন্তুষ্ট নন। বরং তাদের কাজ ভালই লাগছে বলে জানান এ অভিনেতা। তাদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার মতে নতুনরা ভালই করছেন। তাদের অনেকেই পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে নতুন এ শিল্পী-নির্মাতাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা জরুরি। তারা সিনিয়রদের কাছ থেকে যদি সহযোগিতা পান তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে বলেই আমি মনে করি। আর যারা অভিনয়ে আসতে চান তাদের উচিত অন্তত মঞ্চে কিছুদিন কাজ শেখা। কারণ, মঞ্চ হলো অভিনয়ের আঁতুড়ঘর। এখান থেকে অভিনয় শিখে যাওয়া শিল্পীরা জীবনের যে কোন পর্যায়ে গিয়ে ভাল অবস্থান করতে পারবেন বলেই আমি মনে করি। একজন শিল্পীর জন্য মঞ্চ হলো আদর্শ জায়গা। কারণ, মঞ্চে শুধুই অভিনয় শেখানো হয় না। এখানে নিয়ম, শৃঙ্খলা থেকে সবই শেখানো হয়। তবে মঞ্চ ছাড়াও যে ভাল শিল্পী তৈরি হওয়া যায় না সেটা বলাও কিন্তু ঠিক নয়। এখন অনেকেই মঞ্চে কাজ না শিখেও ভাল অভিনয় করছেন এবং এই জায়গাটায় নিজেকে ভালভাবে মেলে ধরছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখিতে বেশ দখল রয়েছে আবুল হায়াতের। এ পর্যন্ত ২২টি বই প্রকাশ হয়েছে তার। বর্তমান সময়ে একাধিক ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত আছেন আবুল হায়াত। সঙ্গে নির্মাণ করছেন ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ নামে একটি ধারাবাহিক। পাশাপাশি আসছে ঈদ উপলক্ষেও অভিনয় করছেন বেশ কিছু খণ্ড নাটকে।
Leave a Reply