গতকাল মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়ি রেলগেট এলাকার আবরার হোটেলের পাশে রেলওয়ের সীমানা দেয়ালচাপায় কুসুম আক্তার (৪০) ও সুধীর চক্রবর্তী (৩৫) নামে দুজন মারা যান। কুসুম নগরের পশ্চিম মাদারবাড়ির যুগী চাঁদ রোডের ওলা পুকুরপাড়ের বাসিন্দা মনিরুল হকের স্ত্রী। মনিরুল নগরীর আগ্রাবাদে টেক্সোডাইস প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি বায়িং হাউসে কর্মরত ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, চট্টগ্রাম পূর্ব মাদারবাড়ি রেলগেট এলাকায় নিরিবিলি আবাসিক হোটেলের ওপর রয়েছে কলেজিয়েট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবছার উদ্দিন এবং আশীষ কুমার শীলের প্রাইভেট কোচিং সেন্টার। সকাল সাড়ে ৮টায় কুসুম তাঁর ছেলেকে সেই কোচিং সেন্টারে ঢুকিয়ে দিয়ে ভবনের নিচে অপেক্ষা করছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টায় কোচিং শেষ হওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফেরার কথা ছিল। হঠাৎ পার্শ্ববর্তী রেলওয়ের সীমানা প্রাচীর ধসে তাঁর ওপর পড়ে। রক্তাক্ত অবস্থায় স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করলেও ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। দেয়াল ধসের খবর শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন কুসুম আক্তারের স্বামী মনিরুলসহ স্বজনরা। তাঁদের আতর্নাদে সেখানে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এদিকে দুপুর সোয়া ১২টায় ইটের স্তূপ থেকে সুধীর চক্রবর্তীকে বের করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত সুধীর চক্রবর্তী পূর্ব মাদারবাড়ি রেলগেট এলাকায় চৌমুহনী পরিবহন কম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। নিহত সুধীরের বাড়ি নোয়াখালী জেলায় বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী আন্তজিলা ট্রাকচালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. বাহার মিয়া বলেন, ‘লোকজনের চোখের সামনেই দেয়ালটি ধসে পড়েছে। ওই মহিলাকে ইটের নিচে চাপাপড়া অবস্থায় পাই। আমরা সবাই মিলে ইট সরিয়ে তাঁকে উদ্ধার করি। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসে খবর দিই।’
বাহার মিয়া আরো জানান, আনুমানিক ছয় ফুট উঁচু সীমানা প্রাচীরটি আগে থেকেই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। দেয়ালের অন্য পাশ্র্বে প্রায় ১২ ফুট উঁচু করে রাখা ছিল ইটের স্তূপ। দুই দিনের বৃষ্টি এবং ইটের চাপে দেয়ালটি ধসে পড়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে সীমানা প্রাচীরটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছিল কয়েক হাজার ইট। শুধু দেয়াল ধসে পড়লে প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না। দেয়ালের পাশ থেকে ইট পড়ে দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।’
ঘটনাস্থলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পূর্ব মাদারবাড়ি রেললাইনের পাশে রেলওয়ের জায়গায় সীমানা প্রাচীর ঘেরা অবস্থায় আছে পাঁচটি পরিবহন কম্পানির অফিস। এর মধ্যে মেসার্স সফল ট্রান্সপোর্ট নামের একটি কম্পানির কার্যালয়ের সামনে রাখা ছিল ইটের স্তূপ। দেয়াল ধসে পড়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলোয় তালা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পালিয়ে যায় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জোবায়ের আহমেদ বলেন, ‘মো. মহসিন নামে এক ব্যক্তি রেলওয়ের জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণের পর বিভিন্ন কম্পানিকে ভাড়া দিয়েছেন।’
কোতোয়ালি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘নিহত দুজনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। রাস্তা থেকে ইটের স্তূপ সরানো হয়েছে। সেখানে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
কুসুমের বাড়িতে আহাজারি : কুসুম আক্তারের মৃত্যু সংবাদ শুনে নগরের পশ্চিম মাদারবাড়ির যুগী চাঁদ রোডের ওলা পুকুরপাড়ের মনিরুল হকের বাড়িতে এলাকার লোকজন দলে দলে এসে ভিড় জমায়। জানা গেছে, মনিরুল নগরের আগ্রাবাদে টেক্সোডাইস প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি বায়িং হাউসে কর্মরত আছেন। মনিরুল ও কুসুমের সংসারে ১১ বছর বয়সের ছেলে ও ৪ বছর বয়সের কন্যা সন্তান রয়েছে। ছেলে তানজিলুর হক লিপ্টন স্থানীয় খাজা আজমেরি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। মেয়ে সামিয়াও একই স্কুলের প্লে গ্রুপের ছাত্রী।
এ সময় মনিরুল হক বলেন, ‘বৃষ্টি দেখে কোচিংয়ে না যাওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু লিপ্টনের মা রাজি হয়নি। এত দিন পরীক্ষার জন্য ছেলে কোচিংয়ে যেতে পারেনি, স্যার বকা দেবে, এসব বলে ছেলেকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সেই বাসায় আর তাঁর ফিরে আসা হলো না।’
ছেলে লিপ্টন কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘কোচিং সেন্টারের নিচে হইচই শুনেছিলাম। আম্মা মারা গেছে এ কথা আমি জানতাম না। পরে কয়েকজন আংকেল গিয়ে আমাকে বের করে বাসায় নিয়ে আসে।’ কাঁদতে কাঁদতে লিপ্টন বলে, ‘আমি স্কুলে গেলে দুষ্টামি করতাম না। বাসায় দুষ্টামি করতাম। মা বলত, দুষ্টামি করিস না। সকালে কোচিংয়ে যাওয়ার সময়ও দুষ্টামি না করতে বলেছিলেন। মা, তুমি ফিরে এসো মা, আমি আর দুষ্টামি করব না। আমাকে কে কোচিংয়ে নিয়ে যাবে মা।’
Leave a Reply