কী জেতেননি! প্রাপ্তির খাতায় কোন অর্জনটা নেই তাঁর! থরে থরে সাজানো ট্রফিকেসে এক ব্যালন ডি’অরই আছে চারটি। তবু অপূর্ণতার চোরাস্রোতে অবিরাম ভেসে চলেছেন লিওনেল মেসি। এত প্রাপ্তি, এত অর্জন সবই যে বার্সেলোনার হয়ে; জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সেখানে ধু ধু বালুচর। ফুটবল-দেবতা বাঁ পায়ে এমন জাদু মেখে দিলেন, যাতে ফুলের সৌরভের মতো নেশা ধরিয়ে দেয় ফুটবলবিশ্বকে। খোলা আকাশে উড়ে বেড়ানো মুক্ত বিহঙ্গের মতো স্বাধীন মনে মাঠের সবখানে নিজের মতো খেলার শক্তি দিলেন তাঁকে। জ্যোৎস্নার আলোর মতো সৌন্দর্য ছড়িয়ে মাঠের সবুজ ক্যানভাসে চোখ ধাঁধানো ফুটবলে বিমোহিত করতে দিলেন ভক্তদের। ক্লাব ফুটবলে সাফল্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গেও তুলে দিলেন, অথচ এত কিছু যাঁকে দিলেন তিনি, জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁর মনে এত হাহাকারের আগুন দিলেন ঢেলে! অনেকে বলেন পৃথিবীর সব আনন্দ যেমন একসঙ্গে সবাই পায় না, মেসির জাতীয় দলের শিরোপা জিততে না পারাটাও তেমনি। তাই বলে কোপা আমেরিকাও জিততে পারবেন না চারবার বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া মানুষটি! এমন যদি হতো একা মেসিকে দিয়ে হচ্ছে না, কিন্তু জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকে সব সময়ই ভালো স্কোয়াড পেয়েছেন তিনি। এর পরও শিরোপাখরা না কাটানোর কারণটা সম্ভবত সমন্বয়ের অভাব। ব্রাজিল বিশ্বকাপে সমস্যাটা কেটেছে আর্জেন্টিনার, ফাইনালে উঠে শিরোপার কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন মেসি। কিন্তু ফুটবল-দেবতা চাননি বলেই তীর্থের কাছে গিয়েও ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। প্রত্যেকটা অর্জনের পেছনে সম্ভবত পরিশ্রমের সঙ্গে ভাগ্যটাও জরুরি। মারাকানায় সেটা পাননি, আজ চিলির বিপক্ষে কোপার ফাইনাল দিয়ে দুর্ভাগ্যের চক্রটা কি ভাঙতে পারবেন মেসি! না পারলে যে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে ধরবে মেসির জাতীয় দলের ব্যর্থতার গল্পগুলো। ১০ বছর আগে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ আর ২০০৮ সালে অলিম্পিক থেকে সোনা জয় এখন পর্যন্ত আকাশি-সাদা জার্সিতে অর্জনের খতিয়ান মেসির। সান্তিয়াগোর আগে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে দুইবার ফাইনালে উঠেছিলেন তিনি, শিরোপা জিতে ফিরতে পারেননি কিন্তু একবারও! এবারের সুবর্ণ সুযোগটি কোনোমতেই হাতছাড়া করতে চান না বার্সেলোনা তারকা, ‘আর্জেন্টিনার এই প্রজন্ম জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা জিততে মুখিয়ে আছে। দল হিসেবে অবশ্যই আমরা শিরোপা জেতার দাবিদার। গত বিশ্বকাপের ফাইনালের পর সেটি আরো অপরিহার্য হয়ে গেছে আমাদের জন্য।’ একই কথা সের্হিয়ো আগুয়েরোর কণ্ঠেও, ‘এই প্রজন্ম যদি কোনো কিছু জিততে না পারে, তাহলে সারা জীবন এই দুঃখ বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের।’ ঘরের মাঠে কি আর ছেড়ে কথা বলবে চিলি? যেখানে কোপার ৯৯ বছরে একবারও শিরোপা জিততে পারেনি তারা। হ্যাঁ, দুর্দান্ত আর্জেন্টিনাকে সমীহ করছে ‘লা রোজা’, তবে ঘরের মাঠে নিজেদের সমর্থকদের সামনে মেসিদের হারানোকে মোটেও অসম্ভব মনে করছে না চিলি। ফাইনালে আলবিসেলেস্তেদের পাওয়ার পরপরই ডিফেন্ডার হোসে রোহাস শুনিয়েছেন শিরোপা জিততে কতটা মুখিয়ে আছেন তাঁরা। আলেক্সিস সানচেস, আরতুরো ভিদাল, ক্লাউদিও ব্রাভো, এদুয়ার্দো ভারগাসদের নিয়ে গড়া চিলিও যে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই আর্জেন্টিনা থেকে। দাপুটে জয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করার মধ্যেই চিলিয়ানরা জানিয়ে রেখেছে সান্তিয়াগোর ফাইনাল কোনোমতেই সহজ হচ্ছে না আর্জেন্টিনার। আর প্রথম শিরোপা জিততে ‘লা রোজা’রা কতটা উম্মুখ, সেটা স্পষ্ট জুভেন্টাস মিডফিল্ডার ভিদালের এই কথায়, ‘এই দলটা দারুণভাবে গড়ে উঠেছে, দেশের হয়ে শিরোপা জেতার এটাই সঠিক সময়। চাপ অবশ্যই আছে, তবে শান্ত আছি, দেখানোর অপেক্ষায় আছি আমরা শক্তিশালী দল।’ চিলিয়ান কোচ হোর্হে সাম্পাওলি পেরুর বিপক্ষে সেমিফাইনালে খেলা একাদশই রাখবেন সম্ভবত আজও। ডিফেন্ডার গনসালো হারা নিষেধাজ্ঞার কারণে কোপা থেকে ছিটকে গেলেও ফিট আছেন বাকি সবাই। আর্জেন্টিনা কোচ জেরার্দো মার্তিনোর চিন্তা আবার চোট নিয়ে। পেটের সমস্যায় প্যারাগুয়ের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ছিলেন না ডিফেন্ডার এসেকিয়েল গারাই। সংশয় রয়েছে তাঁর ফাইনাল খেলা নিয়েও। শেষ পর্যন্ত তিনি ফিট না হলে সুযোগ পাবেন ম্যানসিটি ডিফেন্ডার মার্তিন দেমিচেলিস। ১৯৯৩ সালে সর্বশেষ শিরোপা জেতা আর্জেন্টিনার ট্রফিকেসে সাজানো আছে টুর্নামেন্টটির ১৪টি শিরোপা। যাদের বিপক্ষে লাতিন শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ২৪ বারের সাক্ষাতে একবারও জেতেনি চিলি। বাধার এই দেয়াল এবার ভাঙতে পারবে কিনা, সে উত্তর দেবে সান্তিয়াগের ম্যাচ, এর আগে জেনে নেওয়া যাক দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের পরিসংখ্যান। ইতিহাস বলছে মুখোমুখি লড়াইয়ে যোজন ব্যবধানে এগিয়ে মেসিরা। ৮০ বারের সাক্ষাতে আর্জেন্টিনার ৫৩ জয়ের বিপরীতে ‘লা রোজা’দের জয় মাত্র ৬ ম্যাচে। ড্র হয়েছে বাকি ২১ ম্যাচ! আলবিসেলেস্তেদের বিপক্ষে চিলির সর্বশেষ জয়টা ২০০৮ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে। সান্তিয়াগোর ফাইনালের উত্তেজনার মাঝে উঁকি দিচ্ছে দুই প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক ইস্যুও। হাভিয়ের মাসচেরানো ‘বন্ধুত্বের’ ডাক দিলেও যুগ যুগ ধরে সীমান্ত নিয়ে চলে আসা বৈরিতা কি আর সামনে না এসে পারে! সিঁড়ি বেয়ে বেরিয়ে আসছে ‘ফকল্যান্ড যুদ্ধের’ স্মৃতি। লড়াইটা আর্জেন্টাইনদের ব্রিটিশদের সঙ্গে হলেও চিলি যে সাহায্য করেছিল আটলান্টিকের ওপারের দেশটিকে। আর ফাইনাল সান্তিয়াগোতে বলে স্মৃতির অতল থেকে বেরিয়ে আসছে ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে চিলি-ইতালির ম্যাচটি। দুদলের প্রচণ্ড মারামারিতে চিলির ২-০ গোলে জেতা যে ম্যাচটিকে বলা হয় ‘ব্যাটল অব সান্তিয়াগো’। কোপা আমেরিকার ফাইনালেও যেন সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি!
Leave a Reply