ঢাকার এক আদালতের পেশকার ও পিয়ন বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে আলোচিত ৭৬টি মামলার দাগি আসামিদের জামিন দিয়েছেন। বিনিময়ে আদালতের এ দুই কর্মচারী নিয়েছেন কোটি টাকা। অভিযুক্তরা হলেন- ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের পেশকার মো. মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া এবং পিয়ন শেখ মো. নাঈম। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের একটি প্রতিবেদনে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পেশকার ও পিয়নের সঙ্গে জড়িত দুই আইনজীবীও। বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে জামিনের মাধ্যমে দুই আইনজীবী আসামিদের কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক রোববার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের পেশকার ও পিয়ন বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে শতাধিক মামলার আসামিকে জামিন দিয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত হয়েছে। প্রথমে দু’জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। এরপর তাদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘জালিয়াতির সঙ্গে আরও যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। এর সঙ্গে আইনজীবীরা জড়িত আছে কিনা তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা যুগান্তরকে বলেন, বিচারকের স্বাক্ষর জাল করা গর্হিত অপরাধ। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।
জামিন জালিয়াতির ঘটনায় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. কামরুল হোসেন মোল্লা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। তিনি এতে উল্লেখ করেন, ‘আপনি মো. মোসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া, অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ, ২য় আদালত, ঢাকার বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) পদে কর্মরত থেকে ওই আদালতের এমএলএসএসের সঙ্গে যোগসাজশে ৭৬টি মামলার আসামিদের জামিন, মোটরসাইকেল ও পাসপোর্ট জিম্মায় প্রদান করে দুর্নীতি ও জালিয়াতি করেছেন। অধিকাংশ মামলায় জামিনের আদেশ ছাড়াই মামলার নথিতে জামিনের দরখাস্তসহ জামিননামা সন্নিবেশিত আছে যাতে বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে গুরুতর অপরাধ করেছেন।’ এ অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত দুই কর্মচারীকে কারণ দর্শনোর নোটিশ দেয়া হয়। এ নোটিশের পর সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল) বিধিমালার ১১ ধারা অনুযায়ী রোববার পেশকার মোসলেহ উদ্দিন ও পিয়ন নাঈমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, রোববার বেলা সাড়ে ৩টায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ আদালতের এজলাস থেকেই মোসলেহ উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায়। পিয়ন নাঈম আদালতেই আসেননি রোববার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে জামিন দেয়ার বিষয়টি আদালতের নজরে আসে। পেশকার মো. মোসলেহ উদ্দিন ও পিয়ন শেখ মো. নাঈম যে বিচারকের স্বাক্ষর জাল করেছে বিষয়টি ঢাকার দুই নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক সামছুন্নাহার জানতে পারেন। তার আদালতে বিচারাধীন মামলা নম্বর ৯১/২০০৫ নথিতে দেখেন, আসামিদের জামিননামা আছে অথচ জামিনের আদেশ নেই। এরপর আদালতের আরও ৭৫টি মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে তিনি দেখতে পান, তার স্বাক্ষর জাল করে ১১০ দাগি আসামিকে জামিনের মাধ্যমে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন আদালতের তারই দুই কর্মচারী।
এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২৯ জুন পেশকার ও পিয়নের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. কামরুল হোসেন মোল্লার কাছে স্মারকপত্র পাঠান। এরপর বিষয়টি নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তাদের তদন্তেও বেরিয়ে আসে, পেশকার মোসলেহ উদ্দিন ও পিয়ন টাকার বিনিময়ে দাগি আসামিদের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
হাজী মোসলেম ও পিয়ন নঈমের পাঁচ মাসের কাজ : বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ৭৬টি মামলার ১১০ আসামিকে পাঁচ মাসের ব্যবধানে কারাগার থেকে বের করে দিয়েছে শক্তিশালী এই জালিয়াত চক্র। আদালতের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, পিয়ন শেখ মো. নাঈম ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম-দায়রা জজ আদালত থেকে গত ১১ নভেম্বর বদলি হয়ে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসেন। তার সার্ভিস বুক ও হাজিরা খাতা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নভেম্বরে বদলির প্রায় দু’মাস পর বিচারকের জাল স্বাক্ষর করে টাকার বিনিময়ে আসামিদের জামিন দেয়া শুরু করেন জানুয়ারি মাস থেকে। তার সঙ্গে যোগ দেন পেশকার মোসলেহ উদ্দিন। জানুয়ারি মাসে বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ১৪টি মামলায় ১৪ জন, ফেব্র“য়ারিতে ১০টি মামলার ২০ জন, মার্চ মাসে ১৪টি মামলার ২০ জন, এপ্রিল মাসে ১২টি মামলার ১৬ জন এবং মে মাসে ২৬টি মামলার ৪০ জন আসামির জামিনে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে পিয়ন নাঈম ও পেশকার মোসলেহ উদ্দিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবী যুগান্তরকে বলেন, স্বাক্ষর জাল করে এতগুলো মামলার আসামি জামিন দেয়া হয়েছে অথচ বিচারক তা বুঝতে পারেননি। এ ধরনের জালিয়াত চক্রকে ধরতেও পাঁচ মাসের বেশি সময় লাগার বিষয়টি রহস্যজনক। কেননা পিয়ন বইতে জামিননামার সব তথ্য উল্লেখ থাকে। কবে কোন তারিখে কোন মামলায় জামিন হয়েছে তা খুব সহজেই জানা সম্ভব।
তিনি বলেন, এসব জামিননামা পাঠানো হয় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের নেজারত বিভাগে। নেজাতর বিভাগ জামিনদার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চূড়ান্তভাবে জামিনামা কারাগারে পাঠানো হয়। এর সঙ্গে মহানগর দায়রা জজ আদালতেরও কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারেন। তদন্ত করলে তা বেরিয়ে আসবে।
ঢাকার দুই নম্বর মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিয়ন বুক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এতে জামিন দেয়া মামলাগুলোর নম্বর নেই। ওই পিয়ন বুকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের জামিননামা গ্রহণকারীর স্বাক্ষর-সিলমোহর নেই। অথচ আইন অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরের অধিনস্ত ১৩টি আদালতের যে কোনো জামিননামা গ্রহণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব ঢাকা মহানগর দায়রা জজ নেজারত বিভাগের।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির মো. ওবায়দুল করিম আকন্দ যুগান্তরকে বলেন, ‘অনেক আদালত। প্রতিদিন অসংখ্য জামিননামা আমার কাছে আসে। জামিননামা গ্রহণের পিয়ন বইয়ে হয়তো সিলমোহর মারা হয়নি। তবে অপরাধ করেছে পিয়ন নাঈম ও মোসলেহ।’
আইনজীবীরাই গডফাদার : ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, একজন আসামিকে জামিনে বের হতে হলে আইনজীবী ও স্থানীয় জামিনদার প্রয়োজন। জামিননামায় (বেলবন্ড) আইনজীবী ও জামিনদার উভয়ই স্বাক্ষর করেন। ওই ৭৬টি মামলার আসামির জামিননামায় যে সব আইনজীবীর স্বাক্ষর আছে তারা সবাই এই চক্রের সদস্য। জালিয়াত চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন মাদক সম্রাটখ্যাত এক আইনজীবী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার আদালতের এক পেশকার যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার দুই নম্বর আদালতে সবচেয়ে বেশি মামলা ট্রান্সফার করে নিয়েছেন দুই আইনজীবী।
Leave a Reply