হানিফ মোহাম্মদকে চেনার কথা নয় নাসির হোসেনের। চিনলেও পাকিস্তানি ওপেনারের সেই অমর কীর্তি জানার কথা নয় কোনোভাবে। ১৯৫৮ সালে বার্বাডোজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে দলের দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৭০ মিনিট ব্যাটিং করেন হানিফ। মিনিটের হিসাবে এখনো যা দীর্ঘতম টেস্ট ইনিংস। শুধু তা-ই নয়, টাইমলেস টেস্টের সেই যুগে ট্রিপল সেঞ্চুরি করার পথে পাঁচ দিন ক্রিজে ছিল সেই কিংবদন্তির উপস্থিতি।
বার্বাডোজের সেই হানিফের সঙ্গে চলতি টেস্টের নাসিরের পার্থক্য, টেস্টের পাঁচ দিন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানের উপস্থিতি কেবলই তাত্ত্বিক। প্রথম দিন ঘণ্টাখানেকেরও কম সময় ব্যাটিং করে অপরাজিত ১৩ রানে। পরের তিন দিন তো বৃষ্টির কারণে খেলাই মাঠে গড়ায়নি! আজ তাই খেলা হোক বা না হোক, মুশফিকুর রহিম শুরুতে ইনিংস ঘোষণা না করলে এক অর্থে পাঁচ দিন ক্রিজে থাকবেন তো নাসিরও। যদিও হানিফের ওই কীর্তির পাশে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানকে বসানোর হাস্যকর দাবি নিশ্চয়ই কেউ করবেন না।
করবেন না নাসিরও। অপরাজিত থাকতে থাকতে বরং ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। কাল দিনের খেলা পরিত্যক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসা মাহমুদ উল্লাহর কথাতে স্পষ্ট তা, ”নাসির আজ সকালেই বলছিল, ‘ভাই ভালো লাগছে না। দুদিন ধরে নট আউট আছি।’ আসলে সবাই আমরা খেলতে চাইছি। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতির শিকার। দেখা যাক কাল কী হয়!”
আজ অনেক কিছুই হতে পারে। কাল দুপুরের পর ঘণ্টা তিনেক শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের সবুজ যেভাবে ভেসে গেছে সূর্যালোকে, তাতে আবার ব্যাট-বলের দ্বৈরথে মুখর হতে পারে। আবার গত তিন দিনের ধারাবাহিকতায় বৃষ্টি-অপেরার শেষটা হতে পারে রিমিঝিমি সুরে। তবে চট্টগ্রামের মতো ঢাকা টেস্টেও যে বিজয়ী-বিজিত নির্ধারিত হবে না, এটি একরকম নিশ্চিতই, যদি না ফলের জন্য প্রবল সাহসী কোনো সিদ্ধান্ত না নেন দুই অধিনায়ক। অবশ্য ইনিংস ঘোষণা করে ফলের বন্ধ দুয়ার খুলে দিয়ে হারের ঝুঁকি কোনো অধিনায়ক নেবেন বলে মনে হয় না। তাই ঢাকা টেস্টের সম্ভাব্য ফলও ড্র। আর এতে শীর্ষ দলের বিপক্ষে ড্র করায় আইসিসি র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের যোগ হবে আরো ৬ পয়েন্ট। কিন্তু নাসিরের পাঁচ দিন ব্যাটিং করার মতো সেই সম্ভাবনায়ও আনন্দিত নয় স্বাগতিকরা। কণ্ঠে আরেক দফা হতাশার ঢেউ ঢেলে মাহমুদ তাই বলে যান, ‘৬ পয়েন্ট পাওয়ার চেয়ে খেলাটাই আমরা বেশি উপভোগ করতাম।’
টেস্ট খেলা নিয়ে এমনিতেই হাপিত্যেশ রয়েছে বাংলাদেশের। এক সিরিজের পর আরেক সিরিজের অপেক্ষায় কখনো কখনো তো বছরও পেরিয়ে যায়। সেই হিসাবে চলতি বছরটি ছিল ব্যতিক্রম। পাকিস্তান-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ার মতো চার পরাশক্তির বিপক্ষে পর পর চারটি টেস্ট সিরিজ বলে কথা! এমন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলে খেলেই তো উন্নতির ছক আঁকছিল বাংলাদেশ। অথচ ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সর্বশেষ দুটি ম্যাচের ধারাবাহিকতায় চলতি টেস্টটিও ভেসে গেল বৃষ্টিতে। তাতে পরিসংখ্যানের পাতায় ড্র লেখা থাকলেও বাংলাদেশের আক্ষেপ তাতে কমছে না। মাহমুদের কণ্ঠে সেই সুর, ‘আগেই বললাম এটা বিরক্তকর। আমরা খেলতে এসেছি। যদি খেলাটাই না খেলতে পারি তাহলে তো আর কিছু হলো না। ভালো না খারাপ খেলি সেটা পরের বিষয়। এই চেষ্টা তো আমাদের করতে হবে।’ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের আগে প্রস্তুতিটা যথাযথ না হওয়ার হতাশাও লুকিয়ে রাখেননি তিনি, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পুরো পাঁচ দিন করে যদি দুটি টেস্ট খেলতে পারতাম, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তুতিটা ভালো হতো। এখানে হারি-জিতি যাই হতো, কাজে দিত তা। কারণ আমরা বিশ্বের সেরা দলটির বিপক্ষে খেলতাম। এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক হতো, ভালো হতো। এখানে নিজেদের দক্ষতা আরো ঝালিয়ে নিতে পারতাম বলে।’
সেটি না হওয়ায় রীতিমতো বিরক্তিকর সময়ই পার করছে এখন বাংলাদেশ। টানা তিন দিন খেলা যদি না হয়, তাহলে কাঁহাতক আর সহ্য হয়! ‘এটা খুব কঠিন বিষয়। যখন পাঁচ দিন মাঠে নামার পরিকল্পনা ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামবেন, তারপর টানা তিন দিন খেলা পরিত্যক্ত হওয়া স্বাভাবিকভাবেই বিরক্তকর’- বলেছেন মাহমুদ। তাই বলে তিতিবিরক্ত হয়ে বর্ষায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজনের বিপক্ষে নন তিনি। খেলাটির প্রতি প্রবল ভালোবাসায় বরং সারা বছরই ক্রিকেটে ডুবে থাকতে চান তিনি, ‘আমি তো চাই সারা বছরই খেলা হোক। এখন যদিও বৃষ্টির মৌসুম। আর কখন খেলা আয়োজন করা হবে, সেটি বোর্ডের বিষয়। তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে ক্রিকেটারদের চিন্তা থাকে সারা বছর ক্রিকেট খেলা নিয়ে। এটা নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকতে চাই। কারণ খেলা থাকলে আমাদের জন্যই ভালো।’
সর্বশেষ তিন দিন সেই খেলা রয়েছে কাগজ-কলমে। মাঠে বৃষ্টির রাজত্ব। আগের দিনের মতো কালও দুই দল মাঠে আসে কিন্তু বৃষ্টির তোড়ে আবার ফিরে যায় হোটেলে। তবে খেলা না থাকলেও খেলার বাইরে যে নেই তাঁরা, মাহমুদ বলেছেন তা, ‘আজ (কাল) সকালে ইমরুলের সঙ্গে নাশতার টেবিলে আলাপ করছিলাম যে ম্যাচ হলে কী হতে পারে। এগুলো প্রায়ই আমরা আলাপ করি। রুমে যখন থাকি তখন ব্যক্তিগতভাবে সময় কাটাই। কিন্তু যখন বের হই তখন ক্রিকেট নিয়েই আলোচনা। পরিস্থিতি কী কী হতে পারে? আমাদের কী করা উচিত? একটু-আধটু আইডিয়া শেয়ার করা হয়।’ গত কয়েকটি টেস্টে ভালো শুরুর পরও ব্যাটসম্যানদের ইনিংস বড় না হওয়ার আলোচনা নিজেদের মধ্যে হয় বলেও জানান তিনি, ‘প্রথম ২০-৩০ রান তোলা সবচেয়ে কঠিন। এরপর স্বাভাবিক খেলার সময়। কিন্তু আমরা তিন-চারজন ২০-৩০-৩৫-৪০ রান করে আউট হয়ে গেছি। আমার মনে হয় টেস্ট ক্রিকেটে এটা রীতিমতো অপরাধ। এখন আমরা আলোচনা করে দেখছি কী সমস্যা হচ্ছে। আশা করি, দ্রুত এর সমাধান বের করে ফেলব।’
চলতি টেস্টে সেটি আর বোধকরি হচ্ছে না। হানিফ মোহাম্মদের সঙ্গে নাসির হোসেনও ব্র্যাকেটবন্দি হচ্ছেন না নিশ্চিতভাবে!
Leave a Reply