সিলেটের দর্শক ফুটবল নিয়ে নতুন করে ভাবনার খোরাক দিয়েছে। নেপালের বিপক্ষে এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি ম্যাচ এবং বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপেও তারা দলে দলে মাঠে এসেছিল। তবে বাংলাদেশ দল তাদের প্রত্যাশা মেটাতে পেরেছে সামান্যই। অনূর্ধ্ব-১৬ দল কিন্তু তা করছে না, সত্যিকার অর্থেই তারা দর্শক মাতাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের বিপক্ষে পর পর দুই ম্যাচে জয় নিয়ে তারা মাঠ ছেড়েছে। সেটিও শুধু নয়, এই কিশোর-তরুণদের পায়ে সুন্দর ফুটবলের যে ছায়া দেখা গেছে, তারই প্রশংসা এখন মুখে মুখে।
এটা ঠিক যে, সিলেটে না হলেও যশোর-রাজশাহীতে এবং বঙ্গবন্ধু কাপের ঢাকা পর্বেও ভালো করেছে জাতীয় দল। ইনচিয়ন এশিয়ান গেমস এবং বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সর্বশেষ দুটি ম্যাচেও তারা খুব হতাশ করেনি। সিলেটে অনূর্ধ্ব-১৬ দল ভারতকে হারানোর আগে টানা দুটি ম্যাচ ড্র করেছে ভারতের সঙ্গে, ঢাকায় সর্বশেষ অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ম্যাচটিও শেষ হয়েছে ড্রয়ে, ওই তিনটি ম্যাচেই বাংলাদেশ জেতার অবস্থায় ছিল। অনূর্ধ্ব-১৬ দলের জয়টা তাই আকস্মিক নয় কোনোভাবেই। আলোচনা হচ্ছে তাদের খেলার ধরন নিয়ে। লোডউইক ডি ক্রুইফ বছর দুয়েক আগে দায়িত্ব নেওয়ার সময় থেকেই যে চেষ্টাটা হয়েছে, জাতীয় দল এবং বয়সভিত্তিক দলগুলোতেও একটা নির্দিষ্ট ধরনে খেলানো- অনূর্ধ্ব-১৬ দলের খেলায় তার প্রতিফলন আছে বলেই মনে করেন জাতীয় দলেরই সহকারী কোচ সাইফুল বারী টিটু, ‘আমাদের খেলোয়াড়দের শারীরিক গড়নের কথা চিন্তা করেই ছোট ছোট পাসে খেলার ওপর জোর দিয়েছিলেন ক্রুইফ। তার মধ্যে ডিফেন্স থেকে অ্যাটাক পর্যন্ত ‘কুইক’ ট্রান্সসিশন, উইং দিয়ে আক্রমণ- এসব আমি এই অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দলটার মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি।’ খেলার ধরন প্রতিষ্ঠা করার আগেই গুরুত্বপূর্ণ হলো অবশ্য সেই পরিমাণ খেলোয়াড় কোচের হাতে তুলে দেওয়া, তাদের ন্যূনতম মানও থাকতে হবে। যার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বিকল্প নেই, যেমন বিকল্প নেই ঘরোয়া পর্যায়ে তাদের খেলার সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি। সাইফুল বারীর মতে, গত কয়েক বছরের মধ্যে দেশের তৃণমূল ফুটবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছে তা হলো, বাফুফে ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা। সাফের বর্তমান দলটির কোচ সৈয়দ গোলাম জিলানী এই একাডেমিতেই দায়িত্বপ্রাপ্ত, ডি ক্রুইফের সহকারী হিসেবেও ছিলেন তিনি এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ ও সাফ ফুটবলে। এবার অনূর্ধ্ব-১৬ দল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রতিভার কথাই বলেছেন বারে বারে। সেই প্রতিভা কিন্তু সারা দেশ থেকে একরকম ছেঁকে তুলে আনা হয়েছে।
সর্বশেষ সেইলর অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ছিল এর সূতিকাগার। দেশের ৬১টি জেলা নিয়ে আয়োজিত এই আসর থেকেই প্রাথমিক ট্রায়ালের জন্য বাছাই করা হয়েছিল ২০০ ফুটবলার। বাফুফের কোচদের তত্ত্বাবধানে সেই ট্রায়াল থেকে প্রথমে ৬০, দ্বিতীয় দফা বাছাইয়ে ৪০ এবং সর্বশেষ ৩২ জন ফুটবলারকে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য। মূল স্কোয়াড হয়েছে তাদের মধ্যে থেকেই। কিশোরগঞ্জের ভূইয়া একাডেমিতে ফুটবলের স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠা সারোয়ার নিপুকে কে চিনত সেইলর টুর্নামেন্টের আগে! এখন সাফেই অন্য দলগুলোর কাছে আতঙ্ক হয়ে উঠেছে এই নাম। বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর বি এ জুবায়ের নিপু উচ্ছ্বসিত শুধু খেলোয়াড়দের পারফরমেন্সে নয় বরং তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখে, ‘গত দুটি সাফের তুলনায় এই দলটিকেই আমি এগিয়ে রাখব। তাদের খেলার ধরন, কৌশল এবং লড়াইয়ের মানসিকতা- এক কথায় অসাধারণ। এই খেলোয়াড়দের ধরে রাখাটাই এখন চ্যালেঞ্জ। আমরা ওদের বাফুফে একাডেমিতে নিয়ে নিতে পারি। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ওদের খেলার মধ্যে রাখা।’
সেপ্টেম্বরে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে এই দলটিরই খেলার সুযোগ আছে। এর আগে অনূর্ধ্ব-১২ দল খেলে এসেছে কোরিয়ায়, একাডেমিতে নেওয়ার পরিকল্পনা তাদেরও। তবে নিপু চাইছেন, ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোও যেন বাড়ানো হয়, ‘এএফসির টুর্নামেন্টগুলোতে আমরা অংশ নিচ্ছি। খেলোয়াড় বাছাই, প্রশিক্ষণে কোচরা ভালো কাজও দেখাচ্ছেন। তবে ঘরোয়া আসরগুলোও নিয়মিত হওয়া উচিত। সেই ২০১১তে জেএফএ কাপের পর এ বছর হলো সেইলর টুর্নামেন্ট। মাঝখানের বছরগুলো ফাঁকা গেছে। ২০১২-১৩তে স্কুল ফুটবল হলো, সেটিও এখন বন্ধ। খেলোয়াড়দের জোগানটা নিশ্চিত করতে হলে এই টুর্নামেন্টগুলো নিয়মিত করা ছাড়া উপায় নেই।’ অনূর্ধ্ব-১৬ দলের সাফল্য সম্ভাবনার পাশাপাশি খুঁতগুলোও এভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। আরো বড় লক্ষ্যের পথে সেটি হয়তো পাথেয়ও হবে।
Leave a Reply