২০১৪ জুড়ে টাইগারদের ক্রিকেটে শুধু হাহাকার। বছর শেষ না হতেই দলে পরিবর্তনের সুর। টেস্টে মুশফিককে রেখে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক করা হলো মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। এরপর শুধু আলো আর আলো। শুরুতেই চ্যালেঞ্জ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার দল চমকে দিলো বিশ্বকে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেললো টাইগাররা। তাও ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম শক্তি ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। তবে বিশ্বকাপ শেষ হলো ভারতের বিপক্ষে আম্পায়ারিং বিতর্ক আর হারের আক্ষেপ নিয়ে। সেই আসরেই পরপর দুই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ জ্বলজ্বলে তারা হয়ে রইলেন। দেশে ফিরে অন্য বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬ বছর পর ওয়ানডে জয় দিয়ে শুরু আর শেষ হলো তাদের হোয়াইটওয়াশ দিয়ে। এরপর ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়। বছরটি দলের জন্য কাটে রূপকথার মতোই। কারণ ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে এখন বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টপকে সাত নম্বরে। টেস্টেও খারাপ নয়, এই বছরই ক্রিকেটে সর্বাধিক চার ড্র। দেশের হয়ে তামিম ইকবালের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির সঙ্গে ইমরুলকে নিয়ে ওপেনিংয়ে ৩১২ রানের ইতিহাস গড়া জুটি। তবে ৫ টি-২০ ম্যাচ খেলে সারা বছরে দুই জয়ের একটি আবার পাকিস্তানের বিপক্ষে। তাই টেস্ট ও ওয়ানডের তুলনায় টি-টোয়েন্টি যেন মিটি মিটি আলোর তারা। বাংলাদেশ ক্রিকেট আঁধার কাটিয়ে আলোর পথে ছুটে চলা দ্রুতগামী রকেট। যেখানে শেষ ৬ মাসে চমকের পর চমক দেখিয়ে যুক্ত হয়েছেন গতি বালক মুস্তাফিজুর রহমান।
বিশ্বকাপ থেকে ছুটে চলার ফুয়েল
২০১৫ সালে বাংলাদেশ দল ছুটে চলার রকেটের ফুয়েল পেয়েছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে। যা দেশের মাটিতে ছুটে চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল দ্বিগুণ। এর আগে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ৬ ম্যাচের ৩টিতে জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে টাইগাররা। গ্রুপপর্বে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারানোর পর নিউজিল্যান্ডকেও প্রায় হারিয়ে দিয়েছিল তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে দুর্ভাগ্যবশত ভারতের কাছে হেরে আসর থেকে বিদায় নিয়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নতুন করে খুঁজে পেয়েছিল অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে। টানা ২ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ব্যাট হাতে মুশফিকুর রহীম ছিলেন দুর্দান্ত ধারাবাহিক। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অসাধারণ দু’টি বল করে নায়ক হয়েছিলেন বিশ্বকাপের আগে অখ্যাত নায়িকা হ্যাপির সঙ্গে বিতর্কে জড়ানো রুবেল হোসেন। এই বছরেই অভিষেকে ব্যাট হাতে আস্থার মান রাখেন তরুণ সৌম্য সরকারও।
অনেক প্রাপ্তির পাকিস্তান সিরিজ
বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল উপমহাদেশের অন্যতম পরাশক্তি পাকিস্তান। ১৯৯৯-এর বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের স্মৃতি ছিল না টাইগারদের। কিন্তু এবার সিরিজের প্রতিটি ওয়ানডেতে বিশাল ব্যবধানে জয় তুলে নিয়ে শেষে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডোবায় বাংলাদেশ। একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও জয় দেখে টাইগাররা। এই ম্যাচেই ক্রিকেট বিশ্বকে ভড়কে ও চমকে দিয়ে অভিষেক হয় পেসার মুস্তাফিজুর রহমানের। পাক টি- টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদি ও অভিজ্ঞ হাফিজকে উড়িয়ে দিয়ে তার যাত্রা। এরপর অবশ্য দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে পাকিস্তানের কাছে ১-০তে হেরে যায় মুশফিক বাহনী। তবে খুলনায় সিরিজের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১২ রানের এক অসাধরণ ওপেনিং জুটি গড়েন তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস। তাতেই প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ পায় দারুণ এক ড্র।
নাকাল পূর্ণশক্তির ভারত
২০১৪ সালের জুনে যখন ভারত বাংলাদেশে আসে তখন ছিল অহম আর অহঙ্কারে বুঁদ। তৃতীয় সারির দল নিয়ে এসে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতে যায় তারা। কিন্তু একবছর ঘুরতেই মিটে যায় সেই দম্ভ। এবারও জুনেই আসে পূর্ণশক্তির দল নিয়ে। শুরু হয় টেস্টে সিরিজ দিয়ে। ফতুল্লার একমাত্র টেস্টটি ছিল বৃষ্টিবিঘ্নিত। শেষ পর্যন্ত টেস্টের ড্রতেই শেষ হয়। কিন্তু ভারতকে ভড়কে দেয় ওয়ানডেতে। ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দু’টিতে জিতে বাংলাদেশ সিরিজ জয়। পূর্ণশক্তির দল নিয়ে এসেও ওয়ানডেতে এমন নাকাল হবে ভাবেনি তারা। কিন্তু এই জয়ের অন্যতম ভাগিদার টি-২০’র ওয়ানডে অভিষেক মুস্তাফিজুর রহমান। তার অন্তরালে থাকা অস্ত্র ‘কাটারে’ নেন ৫ উইকেট। দ্বিতীয় ম্যাচে নেন ৬টি। সিরিজে মোট ১৩ উইকেট নিয়ে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে কোনো বোলারের সর্বোচ্চ সংখ্যক উইকেট নেয়ার বিশ্বরেকর্ডও গড়েন এই বাঁহাতি পেসার।
বাঁচেনি সাবধানী দক্ষিণ আফ্রিকাও
দেশের মাটিতে বাংলাদেশের সাফল্য দেখে সাবধানী দক্ষিণ আফ্রিকা ভারসাম্যপূর্ণ দল এসেছিল বাংলাদেশ সফরে। টি-টোয়েন্টি সিরিজের দুটি ম্যাচেই জয় ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ হারলেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের মাটিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়ানডেতে জিতে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে নেয় মাশরাফির দল। এরপর আসে টেস্ট পরীক্ষা। টি-টোয়েন্টির ও ওয়ানডেতে মাশরাফির অস্ত্র বনে যাওয়া পেসার মুস্তাফিজকে তুলে দেয়া হয় মুশফিকের হাতে। চট্টগ্রামে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অভিষেক হয়ে যায় মুস্তাফিজের। সেখানেও এক ওভারে চার বলের মধ্যেই ৩ উইকেট নেন মুস্তাফিজ। সেই সুবাদে ম্যাচে প্রথম ইনিংস লিড নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ দুই দিন বৃষ্টিতে খেলা না হওয়ায় ম্যাচ ড্র হয়। তবে ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে ও টেস্ট অভিষেকে ম্যাচসেরা হওয়ার কীর্তি গড়েন মুস্তাফিজ। ঢাকায় সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের শেষ চার দিন বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ায় দুই দলের টেস্ট সিরিজটা সমাপ্ত হয় ড্র দিয়ে।
ভয় পেয়েছিল কি অস্ট্রেলিয়া!
অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলার কথা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে খেলতে আসেনি তারা। অবশ্য তখন ইংল্যান্ডের সঙ্গে অ্যাসেজ হেরে আর ইনজুরিতে নাকাল অস্ট্রেলিয়া দল। তাই অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাই মনে করেন উড়ন্ত বাংলাদেশের সামনে ভয়েই আসেনি আস্ট্রেলিয়া। তবে সত্যি-মিথ্যা যাই হোক জঙ্গি হামলার ভয়কে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসে জিম্বাবুয়ে।
জিম্বাবুয়ের শুধু টি-টোয়েন্টি জয়
অস্ট্রেলিয়া না আসায় ৩ ম্যাচের ওয়ানডে ও ২ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য জিম্বাবুয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেপ বোর্ড (বিসিবি)। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে ওয়ানডে সিরিজের সবগুলো ম্যাচই বিজয় কেতন উড়িয়ে চলে মাশরাফির দল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি হেরে যায় মাশরাফিরা। একটি মাত্র টি-টোয়েন্টি জয়ের সান্ত্বনা নিয়ে ফিরে যায় জিম্বাবুয়ে।
ওয়ানডেতে চমকের নাম বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মাঠের পারফরম্যান্সের কারণে ধরাশায়ী হয়েছে এশিয়ার জায়ান্ট ভারত-পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এ বছর ১৮টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ১৩টি জয় নিয়ে ৭২ ভাগ জয় তুলে নিয়ে সবার উপরে রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। তারা ২৩ ম্যাচ খেলে ১৩ টি জয়ের কারণে তাদের জয়ের হার ৫৬ শতাংশ। সফলতার দিক দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান দুইয়ে। সবার উপরে আছে অস্ট্রেলিয়া। সেই আইসিসি’র র্যাঙ্কিংয়ে ৭ নম্বরে। সেই সুবাদে ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতেও খেলবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আগে ৬ নম্বরে ইংল্যান্ডের অবস্থান। আর বাংলাদেশের পরই ৮-এ পাকিস্তান ও ৯-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
Leave a Reply