তিনি শচীন টেন্ডুলকার নন। আবার কখনো কখনো যেন তাঁরই এ যুগের মিনিয়েচার! দেশের প্রথম টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর রহিমে টেন্ডুলকারের ছায়া দেখতে পাওয়াটা অবশ্য পুরনো। ভারতীয় ব্যাটিং কিংবদন্তির মতো তিনিও নেট ছাড়েন সবার শেষে, ঐচ্ছিক দিনগুলোতে মাঠকর্মী থেকে সংবাদকর্মী—সবাই জানেন একজন ঠিকই ছুটে আসবেন মিরপুরে। এবং তিনি অবশ্য মুশফিক। কাল বিরান একাডেমির মাঠে কখনো নেটে, কখনো বোলিং মেশিনের সামনে ঘণ্টা পার করে দেওয়ায় তাই নতুনত্ব নেই।
নতুনত্ব নেই কে বলল? কিছুদিন ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলেছেন লিটন দাশ। জিম্বাবুয়ে সিরিজের স্কোয়াডে নুরুল হাসানের অন্তর্ভুক্তি অন্তত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পরোক্ষ চ্যালেঞ্জ নিয়েই সামনে দাঁড়িয়েছে মুশফিকের। তিনি নিজে লিটনকে মনে করেন নিজের চেয়ে শ্রেয়তর উইকেটরক্ষক। নব সংযোজন নুরুল আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগেই পেয়ে গেছেন সার্টিফিকেট—এ মুহূর্তে দেশের সেরা উইকেটরক্ষক! আর এত দিনের অভ্যস্ত কিপিং গ্লাভস খুলে রাখলে আউটফিল্ডে খুবই সাধারণ মানের দেখায় মুশফিককে। স্বতঃসিদ্ধ এ ব্যাপারটা তিনিও মানেন, বিশেষজ্ঞ উইকেটরক্ষকদের আউটফিল্ডে একটু বেমানানই দেখায়। অগত্যা ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটে মুশফিকের জন্য পড়ে রয়েছে শুধু ব্যাটটা, তাও শুধু ক্লাসিকাল কাভার ড্রাইভ হলেই হবে না, তোমাকে আনঅর্থডক্স সব শটসও রপ্ত করতে হবে। তাঁর এবারের ‘নিউ ইয়ার রেজ্যুলিউশন’ও যেন এটাই— শটের সংখ্যা বাড়াও।
‘আধুনিক ক্রিকেটে শটের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। টি-টোয়েন্টির জন্যই এটা বেশি হচ্ছে। অনেক শটের তো কোনো নামও নেই। ক্রিকেটে টিকে থাকতে হলে আপনাকে ইনোভেটিভ হতেই হবে’, প্রায় ঘণ্টা দুয়েক একা একা অনুশীলনের পর এক কাপ লেবু চা হাতে বলছিলেন মুশফিকুর রহিম। টি-টোয়েন্টিতে আর কাভার ড্রাইভের কদর নেই, কারণ ব্যাটসম্যানদের সবচেয়ে প্রিয় এ শট খেলার পথটাই এ ফরম্যাটে বন্ধ করে দেন বোলার। সঙ্গে দ্রুত রান তোলার চাপ থাকে বিধায় সোজা ব্যাটের চেয়ে টি-টোয়েন্টিতে আড়াআড়ি ব্যাটে সাইড শটের কার্যকারিতা বেশি।
তাই অন্য অনেকের মতো বদলে গেছে মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং ড্রিলও। সাধারণ টার্ফে পেস আর স্পিনে ম্যাচ সিনারিও ব্যাটিংয়ের পর দূরের কোণে বোলিং মেশিনের সামনে ‘অক্রিকেটীয়’ শটস রপ্ত করায় ব্যস্ত তিনি। পারফেকশনের জন্য নেটে কটা শটস খেলা লাগে—প্রশ্নটা শুনে হাসেন মুশফিক, ‘পারফেকশনের তো শেষ নেই। বিষয়টি নির্ভর করে আপনি কটা শট খেলার পর স্বস্তিবোধ করছেন, তার ওপর। এক বালতি বলের পাঁচ-ছটা যদি ঠিকঠাক না খেলতে পারি, তাহলে আরেক বালতি বল খেলি।’ এক বালতিতে ৩৮টা বল থাকে। তো, অঙ্ক কষে দেখা গেল পুল প্র্যাকটিসটা মুশফিক থামালেন তিন বালতি বল খেলে। তবে শরীর বরাবর ধেয়ে আসা বল উইকেটরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে গ্লাইড করার ড্রিলটা এক বালতিতেই সেরে নিলেন মুশফিক। এটা টেন্ডুলকারের ট্রেডমার্ক শট—দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে ফাস্ট বোলারদের ইটের বদলে পাটকেল হিসেবে যা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। কিন্তু গত এক যুগে এ শটেও আনতে হয়েছে নতুনত্ব। থার্ডম্যান একটু সরে এলেই স্লিপের ওপর দিয়ে খেলা প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সবচেয়ে নিরাপদ উইকেটরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে গ্লাইড করা।
কিন্তু এই এক-দুই কিংবা তিন বালতি বল খেলেই কি চূড়ান্ত পারফেকশন আসে? ‘তাহলে তো আর ম্যাচে কোনো ব্যাটসম্যান আউটই হতো না! ক্রিকেটে পারফেকশন আসে না, কমফোর্ট আসে। আবার দুঃসময়ে সেটা চলেও যায়। তখন আবার আপনাকে সব কিছু নতুনভাবে শুরু করতে হবে’, নিজের জীবনাচারই যেন বললেন মুশফিক।
ইনজুরি হামলে না পড়লে তিন ফরম্যাটেই টানা খেলে চলেছেন। তবু টি-টোয়েন্টি তাঁকে ঠেলে দিয়েছে নতুন পরীক্ষায়। এত দিন স্ট্যান্স নিলে মুশফিকের ডান কাঁধটা আড়াল পড়ে যেন বাঁ কাঁধে। কিন্তু এখন সেটি দৃশ্যমান, একটু ওপেন স্ট্যান্সে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। ব্যাক লিফট দেখলে মনে হবে বুঝি বেসবলের পিচারের কাছ থেকে ছুটে আসা বল উড়িয়ে মারার অভিলাষে ব্যাট তুলে দাঁড়িয়ে সুইংয়ের সময়টা কমানোর জন্য। না দেখেই যে মুশফিকের ব্যাটের-বলের সংঘর্ষের ‘সুইট সাউন্ড’ শুনে বিমোহিত হয়েছিলেন ডেভ হোয়াটমোর, সেই একই ব্যাটসম্যানের পুল শটের শব্দটা দুম-দাম, যেন ৬.৮ মাত্রা ভূমিকম্পে পিলার-টিলার ভেঙে পড়ছে! শরীর বরাবর বাউন্সার উইকেটরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে বল পাঠাতে গিয়ে প্রায়ই ব্যাটের কানায় খেলে ক্যাচের মতো যাচ্ছিল স্লিপে। ঝুঁকি প্রতি মুহূর্তে, তবু শটটা রপ্ত করতেই হবে মুশফিককে, ‘এ ফরম্যাটে ঝুঁকি আপনাকে নিতেই হবে। কখনো জিতবেন, কখনো হারবেন।’
তিনিও জেতেন এবং হারেন। কিন্তু একটা জায়গায় মুশফিক বরাবরের জয়ী। তাঁর অধ্যবসায়ে শুক্র-শনি নেই। একার অনুশীলন মানে গাঁটের খরচেও আপত্তি নেই। তাঁর এ ‘সিরিয়াসনেস’ নিয়ে ড্রেসিংরুমে মৃদু অস্বস্তি আছে বটে। তবে ভেতরে ভেতরে শ্রদ্ধাবোধটাই বেশি—সবার কাছেই অনুকরণীয়ও তিনি!
Leave a Reply