এই ম্যাচের একটা দৃশ্য যদি ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মতো হয়, সেটি কোনটি?
আহমেদ শেহজাদের ব্যাট থেকে চোখজুড়ানো ওই এক্সট্রা কাভার ড্রাইভের কথা বলবেন না। শহীদ আফ্রিদির কোনো শটের কথাও না। আফ্রিদি ১৯ বছরের ক্যারিয়ারে এমন শট অনেক খেলেছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো খেলবেন।
ম্যাচের সুন্দরতম দৃশ্য আসলে সৌম্য সরকারের ওই ক্যাচটা। একটি ফ্রেমে যা আটকে রাখার মতো নয়। কমপক্ষে তিনটি ফ্রেম তো লাগবেই। ছক্কা হতে যাওয়া বলটা ধরে অমন ওপরে ছুড়ে দিয়ে বাইরে চলে যাওয়া। লাফ দিয়ে আবারও মাঠে ঢোকা। দুহাত বাড়িয়ে মাঠের বাইরে চলে যাওয়া বলটাকে ক্যাচ বানানো। উপস্থিত বুদ্ধি, শারীরিক সক্ষমতা, নমনীয়তা সবকিছুর সংমিশ্রণে অসাধারণ এক ক্যাচ।
সমস্যা হলো, এই ম্যাচে বাংলাদেশের মনে রাখার মতো আর কিছুই নেই। টি-টোয়েন্টিতে ১৪ ইনিংস পর পাওয়া ফিফটিটাকে সাকিব আল হাসান হয়তো মনে রাখবেন। চেনা ইডেনে রানে ফেরা সামনের ম্যাচগুলোয় কাজে লাগলেও লাগতে পারে। এই ম্যাচে এটা শুধুই ব্যক্তিগত অর্জন। দলীয় প্রেক্ষাপটে যেটির তাৎপর্য শুধুই পরাজয়টাকে একটু সম্মানজনক করা। টি-টোয়েন্টিতে ৫৫ রান এত বড় ব্যবধান যে, ‘একটু কম অসম্মানজনক’ বললেও বোধ হয় ভুল হবে না।
মাশরাফি বিন মুর্তজার জন্য গত কিছুদিন সংবাদ সম্মেলন মানেই এক আনন্দ সম্মেলন। অনেক দিন পর সেখানে তিনি এমন বিধ্বস্ত চেহারায়। টসে হারাটা যেন তাঁর নিয়তি হয়ে গেছে। জিতলে আফ্রিদির মতো তিনিও প্রথমে ব্যাটিং করার কথাই জানিয়ে দিতেন। প্রথমে বোলিং করতে হওয়াটাকে তখনো এমন সর্বনাশা কিছু বলে মনে হচ্ছিল না তাঁর। ইডেনের উইকেট যে ভুল বুঝিয়েছিল তাঁকে, ‘উইকেটে একটু ঘাস ছিল, ভেবেছিলাম বল একটু ধরবে, কিন্তু আমরা পুরো ভুল বুঝেছি।’
ম্যাচটা বাংলাদেশ কোথায় হেরেছে—এই প্রশ্নের উত্তর মাশরাফির কাছ থেকে জানার দরকার নেই। খেলা দেখে থাকলে যে কারোরই তা বুঝে ফেলার কথা। মাশরাফি সেই জানা কথাটাই বললেন, ‘প্রথম ৬ ওভার থেকেই আমরা ম্যাচটা ধরতে পারিনি।’ ৬ ওভারের পাওয়ার প্লেতে পাকিস্তান তুলে ফেলেছে ৫৫ রান। আফ্রিদি-ঝড়ে ইনিংসের শেষ দিকটায় মনে হলো, তখনো বোধ হয় পাওয়ার প্লেই চলছে! ফিল্ডাররা কে কোথায় দাঁড়িয়েছেন, তাতে কিছু আসে যাচ্ছে না। ১৪ নম্বর ওভারে নামার সময় স্কোর ১২১। শেষ ওভারে আউট হওয়ার সময় ১৯৮। অঙ্কে ভালো হলে হিসাব করে ফেলেছেন, মাঝের ৩৫ বলে রান হয়েছে ৭৭। এর ৪৯-ই আফ্রিদির অবদান।
ধর্মশালা থেকে কলকাতা রওনা হওয়ার দিন বিমানবন্দরে মাশরাফি বলছিলেন, ‘আফ্রিদিকে আপনি কখনোই হিসাবের বাইরে রাখতে পারবেন না। ও যেকোনো সময় ১৫ বলে ৩০ রান করে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে।’ বাস্তবে যা হলো, সেটি ছাড়িয়ে গেল মাশরাফির আশঙ্কাকেও। স্কোরটা যে বাংলাদেশের নাগালের এমন বাইরে চলে গেল, সেটির মূলেও তো আফ্রিদি। যে কারণে মাশরাফিকে দুঃখভরে বলতে হলো, ‘১৬০-১৭০ রান হলেও আমরা চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু পাকিস্তানের এই বোলিংয়ের বিপক্ষে ২০০ রান করা খুব কঠিন।’
অমন ব্যাটিংয়ের পর আমিরের সঙ্গে যৌথভাবে বোলিংয়েও পাকিস্তানের সফলতম বোলার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরু করলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে নিয়ে। ম্যাচ শেষে অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলনে আসা নিয়ম। ম্যান অব দ্য ম্যাচেরও। কী আশ্চর্য, দুটিকেই এক বিন্দুতে মিলিয়ে দেওয়ার পরও শহীদ আফ্রিদি সংবাদ সম্মেলনে এলেন না। পাঠালেন মোহাম্মদ হাফিজকে। পাকিস্তানের সাংবাদিকেরা আগেই এটি অনুমান করেছিলেন। নতুন কোনো বিতর্কের ভয়ে আফ্রিদি আসবেন না।
আফ্রিদির ওই ইনিংস কোনো বিস্ময় নয়। ২০১ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের কখনোই তা করে ফেলার সম্ভাবনা জাগাতে না পারাও। কালকের ম্যাচে বিস্ময় যদি কিছু থাকে, তার এক নম্বরে থাকবে সৌম্য সরকারের ওই ক্যাচ। নাকি সেটিকেও ছাড়িয়ে গেছে ইডেনের গ্যালারি?
কলকাতায় খেলা, তার ওপর পাকিস্তানের বিপক্ষে—গ্যালারি তাই বাংলাদেশের পক্ষেই মুখর থাকবে বলে ধরে নিয়েছিলেন সবাই। অথচ বাংলাদেশ থেকে আসা সমর্থকদের চিৎকারও হারিয়ে গেল স্থানীয় দর্শকদের পাল্টা চিৎকারে। যাতে মোহাম্মদ হাফিজ পর্যন্ত বিস্মিত, ‘কলকাতায় গ্যালারি থেকে “পাকিস্তান জিতেগা” শোনাটা দারুণ ব্যাপার।’
মেলবোর্নে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ক্রিকেট নিয়ে দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে যে তিক্ততার শুরু, সেটি তাহলে এমন চরমে পৌঁছে গেছে!
স্কোরকার্ড
টস: পাকিস্তান
পাকিস্তান
রান বল ৪ ৬
শারজিল ব আরাফাত ১৮ ১০ ১ ২
শেহজাদ ক মাহমুদউল্লাহ ব সাব্বির ৫২ ৩৯ ৮ ০
হাফিজ ক সৌম্য ব আরাফাত ৬৪ ৪২ ৭ ২
আফ্রিদি ক মাহমুদউল্লাহ ব তাসকিন ৪৯ ১৯ ৪ ৪
আকমল ক সাকিব ব তাসকিন ০ ২ ০ ০
মালিক অপরাজিত ১৫ ৯ ২ ০
ওয়াসিম অপরাজিত ০ ০ ০ ০
অতিরিক্ত (লেবা ১, ও ১, নো ১) ৩
মোট (২০ ওভারে, ৫ উইকেটে) ২০১
উইকেট পতন: ১-২৬ (শারজিল, ২.৩ ওভার), ২-১২১ (শেহজাদ, ১৩.৫), ৩-১৬৩ (হাফিজ, ১৬.৪), ৪-১৭৫ (আকমল, ১৭.৫), ৫-১৯৮ (আফ্রিদি, ১৯.৪)।
বোলিং: তাসকিন ৪-০-৩২-২, আল আমিন ৩-০-৪৩-০, আরাফাত ৪-০-৩৪-২, সাকিব ৪-০-৩৯-০ (ও ১), মাশরাফি ৩-০-৪১-০ (নো ১), সাব্বির ২-০-১১-১।
বাংলাদেশ
তামিম ক ওয়াসিম ব আফ্রিদি ২৪ ২০ ০ ২
সৌম্য ব আমির ০ ২ ০ ০
সাব্বির ব আফ্রিদি ২৫ ১৯ ৫ ০
সাকিব অপরাজিত ৫০ ৪০ ৫ ১
মাহমুদউল্লাহ ক শারজিল ব ওয়াসিম ৪ ৫ ০ ০
মুশফিক ক সরফরাজ ব আমির ১৮ ২১ ৩ ০
মিঠুন ক আমির ব ইরফান ২ ৪ ০ ০
মাশরাফি অপরাজিত ১৫ ৯ ২ ১
অতিরিক্ত (লেবা ৪, ও ৪) ৮
মোট (২০ ওভারে, ৬ উইকেটে) ১৪৬
উইকেট পতন: ১-১ (সৌম্য, ০.৩), ২-৪৪ (সাব্বির, ৫.৫), ৩-৫৮ (তামিম, ৭.৬), ৪-৭১ (মাহমুদউল্লাহ, ১০.২), ৫-১১০ (মুশফিক, ১৬.৪), ৬-১১৭ (মিঠুন, ১৭.৪)।
বোলিং: আমির ৪-০-২৭-২ (ও ২), ইরফান ৪-০-৩০-১ (ও ১), রিয়াজ ৪-০-৩১-০, আফ্রিদি ৪-০-২৭-২, মালিক ২-০-১৪-০ (ও ১), ওয়াসিম ২-০-১৩-১।
ফল: পাকিস্তান ৫৫ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: শহীদ আফ্রিদি।
Leave a Reply