আজকের বাংলাদেশের যুবসমাজ যখন অপ্রতিরুদ্ধ। ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার গভীর প্রত্যয়ে মগ্ন। বিশ্ব যখন বাংলাদেশকে বলছে, ‘বাংলাদেশ বিশ্বের বিস্ময়’ যে দেশের তরুণরা, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে বাংলার নিশান লাল-সবুজ পতাকাকে শুধু সম্মানিত করছে না, মহিমান্বিত করে তুলছে। তখন অনেকেরই জানার কৌতূহল সৃষ্টি করছে। দুর্বার গতিতে বাঙালি এই এগিয়ে যাওয়ার শক্তি কোথা থেকে পায়? হ্যাঁ আমাদের জানতে হবে আদর্শিক শক্তির উৎসকে। শিকড়ের সন্ধান করতে হবে। যত জানবো ততই শক্তি পাবো। চেতনার ভিত মজবুত হবে আমাদের। সম্প্রতি ভারতের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে বাংলাদেশের মাবিয়া ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক জিতে ভিনদেশে উড়ালো লাল-সবুজ পতাকা। জাতীয় সংগীতের সুরে মাবিয়া কাঁদলো, তার সঙ্গে কাঁদলো গোটা দেশের মানুষ। এ অশ্রুজল অর্জনের। আমাদের তামিম ইকবাল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান আজ শুধু বাংলাদেশের নয়, দিনে দিনে বিশ্বের সম্পদ হয়ে উঠছে।
গতকালের খবরের কাগজগুলোতে ভারতের অন্যতম সেরা গুণী শিল্পী অমিতাভ বচ্চনের একটি মন্তব্য পড়লাম। বাংলাদেশের টাইগারদের খেলা দেখে অমিতাব বচ্চন মুগ্ধতায় সেখানে বলছেন, ‘বাংলাদেশকে যত দেখছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। কী খেলছে ছেলেগুলো! কী প্যাশন! আহা! চোখ জুড়িয়ে যায়।’ বাঙালি তারুণ্যের জয়জয়কার এ-তো নতুন ইতিহাস নয়। জগতে একমাত্র বাঙালি তরুণরাই ইতিহাস গড়েছে। মায়ের ভাষার জন্য, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির সংগ্রামের জন্য, যারা জীবন দিতে পারে। জীবনের বিনিময়ে ‘মা’ শব্দকে নিজের করে অর্জন করতে পারে। নীল আকাশে লাল-সবুজ পতাকা উড়ানোর অধিকার, জীবনের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনতে পারে। বাংলার মাটিতে এ অর্জনগুলোর ধারাবাহিকতা আছে, আছে ঐতিহ্য।
বাঙালির সমস্ত অর্জনে তরুণ শেখ মুজিব ছিলেন এক অগ্রগামী সাহসী দ্বীপশিখা। বাঙালির প্রতিবাদী প্রতিটি গণ-আন্দোলনে শেখ মুজিবের যুক্ত হওয়া যেন এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে বিরল নেতৃত্বগুণ তৈরির ক্ষেত্রে শেখ মুজিব ছিলেন সদা প্রস্তুত। বাঙালির সব আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে তরুণ শেখ মুজিব তিল তিল করে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। দিনে দিনে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিপক্বতায় শেখ মুজিব থেকে বাঙালির ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার ফলে আমরা জাতি হিসেবে খুঁজে পেলাম ‘মুক্তির সনদ’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬৬-এর ৬ দফার ভেতরেই জেগে উঠেছিল বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। বাঙালি অর্জন করলো ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ।
Sincerity of purpose and honesty of purpose এ শিক্ষার ভিত নিয়ে খোকা মুজিব; পিতা লুৎফুর রহমানের কাছ থেকে বেড়ে উঠেছিলেন। মুজিব থেকে শেখ মুজিব হয়ে ওঠার চমৎকার বর্ণনা উঠে এসেছে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’। বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘আমার জন্ম হয় ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে। আমার আব্বার নাম শেখ লুৎফুর রহমান। আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এমই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্রই ইংরেজি স্কুল ছিল, পরে তা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে।’ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পারিবারিক পরিচিতি আমাদের বলে দেন সমাজকে, সমাজের মানুষকে কিছু দেয়ার মানসিকতা নিয়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সবুজ ছায়াঘেরা পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন খোকা শেখ মুজিব। ১৯৩৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, তখন বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ দুর্বল হয়ে পড়লে তার পিতা কলকাতায় নিয়ে যান চিকিৎসা করাতে। নিজের সম্পর্কে ছোটবেলায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ছোট সময় আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম ও খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর পিতার মনোভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করছে, তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাবো না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দেবো না।’
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয়ে পড়াশোনায় ছাত্র শেখ মুজিবের প্রস্তুতির অন্ত ছিল না। সিপাহি বিদ্রোহ ওহাবি আন্দোলন বৃটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার প্রেক্ষাপট, তিতুমীরের জিহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফারায়জি আন্দোলন সম্পর্কে ছাত্র শেখ মুজিবের বিস্তর আগ্রহ ছিল। আর এসব পড়াশোনার মধ্য দিয়ে, মানুষ-সমাজকে চেনার পাশাপাশি সেবার ব্রত নিয়ে শেখ মুজিব তাঁর সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে হয়ে উঠে ছিলেন আদর্শের আলোকবর্তিকা। আজ বাংলার চেতনার বাতিঘর।
‘Sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না, এ কথা কোনো দিন ভুলিও না’ পিতা লুৎফুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া এই শিক্ষা বঙ্গবন্ধু কোনো দিন ভুলেননি। তার জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে স্তম্ভরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই শিক্ষা। বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়লে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কাজে বাংলার জনগণের প্রতি, তাঁর প্রতিটি প্রতিশ্রুতিতে এমনকি বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর দুর্লভ সাহসিকতায় Sincerity Ges honest ছিল একমাত্র শক্তি উৎস। বঙ্গবন্ধু আমাদের বিশ্বাসের শেষ ঠিকানা। এ বিশ্বাস আমাদের সততার শিক্ষা দেয়। অন্যায়ে মাথা নত না করার শক্তি জোগায়। বাংলাদেশকে সবকিছুতে বিজয়ী করতে আমাদের শক্তি জোগায়। বিশ্বের দরবারে নানা অর্জনে, গৌরবে আমাদের তাগিদ দিতে থাকবে। বাংলাদেশ আরও প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে থাকবে। জয় বাংলা…
লেখক: সমাজকর্মী ও সংসদ সদস্য
Leave a Reply