বিনা পরোয়নায় গ্রেপ্তার ও হেফাজতে নিয়ে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ-সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারার বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকল। আদালত বলেছেন, ৫৪ ও ১৬৭ ধারার কিছু বিধিবিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা (গাইডলাইন) করে দেওয়া হবে। হাইকোর্টের রায়ে দেওয়া নির্দেশনার ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন আসবে।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। গত ১৭ মে এ-সংক্রান্ত আপিল শুনানি শেষে গতকাল রায়ের তারিখ ধার্য ছিল। সকালে রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেন, ‘আপিল ডিসমিসড। তবে কিছু মডিফিকেশন থাকবে। বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের বিষয়ে কিছু গাইডলাইন দিয়ে দেব আমরা।’
১৯৯৮ সালে রাজধানীতে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের পর ডিবি পুলিশের হেফাজতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার জের ধরে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধন চেয়ে আদালতে রিট আবেদন হয়। দীর্ঘ ১৮ বছর আইনি লড়াই শেষে নিষ্পত্তি হলো আলোচিত এ মামলা।
রায়ের পর গতকাল আইনজীবীরা বলেন, আপিল খারিজ করায় হাইকোর্টের রায় বহাল থাকল। আদালত হাইকোর্টের রায়ের কিছু সংশোধনী দেবেন, কিছু নীতিমালা করে দেবেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর বিস্তারিত জানা যাবে। সর্বোচ্চ আদালত বিনা পরোয়নায় কাউকে গ্রেপ্তার (৫৪ ধারায়) ও যেকোনো মামলায় হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের (১৬৭ ধারায়) বিষয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখায় এটি মানতে এখন সরকার বাধ্য। সর্বোচ্চ আদালতের গাইডলাইন মেনে চলতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
ঔপনিবেশিক শাসন পাকাপোক্ত ও চিরস্থায়ী করার জন্য ১৮৯৮ সালে ফৌজদারি আইন পাস করা হয়। এই আইনের ৫৪ ধারায় পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। যখন-তখন যাকে-তাকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা থাকায় যেকোনো ঘটনায় সন্দেহমূলকভাবে গ্রেপ্তার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গ্রেপ্তার অনেকে পুলিশি হেফাজতে হয়রানির শিকার হয়। কখনো কখনো পুলিশ হেফাজতে আটক ব্যক্তির মৃত্যুর নজিরও রয়েছে দেশে।
রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হলে বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে তৎকালীন সরকার। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)
হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট রায়ে ঔপনিবেশিক এ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় কিছু সংশোধনী আনতে সুপারিশ ও নির্দেশনা দেন।
তবে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা আজও মানা হচ্ছে না। যেহেতু হাইকোর্টের নির্দেশনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছিল সে কারণে এত দিন মানার বাধ্যবাধকতাও ছিল না।
এখন আইনজীবীরা মনে করছেন, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখায় পুলিশ হেফাজতে হয়রানি ও বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের হার কমবে। রিমান্ডে নিয়ে আসামির সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে তা নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না আইনে। হাইকোর্ট রায়ে পাঁচটি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ তা বহাল রেখেছেন। কিছু নীতিমালাও দিয়ে দেবেন রায়ে। এমন নীতিমালা হলে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের হারও কমে আসবে।
রাষ্ট্রপক্ষে এই আপিল পরিচালনা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অ্যাডভোকেট ইদ্রিসুর রহমান প্রমুখ মামলা পরিচালনা করেন।
রায়ের পর ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল ডিসমিস হয়ে গেছে। এর অর্থ হচ্ছে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকল। তবে আদালত যেহেতু বলেছেন কিছু সংশোধনী ও গাইডলাইন দেবেন, সে কারণে এখনই বলা যাচ্ছে না রায়ে কী থাকছে আর কী থাকছে না। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর বিশ্লেষণ করে বলা যাবে কী হলো। তবে মনে হচ্ছে, আমরা ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করছি।’
ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। পুলিশি নির্যাতন থেকে মানুষ রক্ষা পাবে। জিজ্ঞাসাবাদের পুরনো সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাবে মানুষ।’ তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকবে।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো বহাল থাকছে। তা মানায় এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হলো। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হলো। বিনা কারণে গ্রেপ্তার বা হয়রানি দূর হবে।
অ্যাডভোকেট ইদ্রিসুর রহমান বলেন, এই রায়ে বলা হয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশনা ও সুপারিশগুলোর বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করে দেবেন আপিল বিভাগ। তাই পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এর আগে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৯ ও ৪৩৯ এ ধারা নিয়ে একটি মামলায় ধারা দুটি সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু ৩৩ বছরেও ওই রায় কার্যকর করা হয়নি বলে আদালত উল্লেখ করেন। রায় কার্যকর না করা নিয়ে এই আপিলের শুনানির সময় আদালত দুঃখ প্রকাশ করেন। অ্যাডভোকেট ইদ্রিসুর রহমান এ কথা জানান। ইদ্রিসুর রহমান আশা করেন, আপিল বিভাগের গতকালের রায় মেনে চলে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁর কার্যালয়ে বলেন, ‘সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ আছে ৩১, ৩৫ বা মানবাধিকারসংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলো। আদালতের অভিমত হলো যে আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন বা পুলিশদের কাজ করা সংক্রান্ত পিআরবি, এ সমস্ত আইন আর সংবিধান এটা পরিপন্থী হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন সে রায়টি ছিল কিছু মন্তব্য বা কিছু রিকমেন্ডেশন। সংবিধানে যে বিধিবিধান তার আলোকে ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন ইত্যাদি সংশোধনের প্রয়োজন মনে করে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছিল। এটি খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।’ আপিল বিভাগ এ বিষয়ে নিজেরা আবার কিছু মডিফিকেশন, রদবদল করবেন বলে উল্লেখ করেছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আপিল বিভাগ যে রায় দেবেন বা যে সমস্ত নির্দেশনা দেবেন তার আলোকে সরকার পদক্ষেপ নেবে। সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশের পরিচয় দেওয়া উচিত। যারা পরিচয় না দিয়ে গ্রেপ্তার করে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক নয় বলে মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, হাইকোর্ট রায়ে ৫৪ ও ১৬৭ ধারার বিধান ছয় মাসের মধ্যে সংশোধন করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে ১২ দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সরকারকে বলা হয়। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে আপিল করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। তখন আপিল বিভাগ লিভ পিটিশন মঞ্জুর করলেও হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো স্থগিত করা হয়নি। ১৩ বছর পর ওই আপিলের ওপর গতকাল রায় হলো।
৫৪ ধারা সংশোধনে হাইকোর্টের রায়ে দেওয়া নির্দেশনা
(ক) কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশকে তার নিজের পরিচয় দিতে হবে, প্রয়োজনে গ্রেপ্তারকারীর পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।
(খ) গ্রেপ্তারের পর ওই ব্যক্তিকে দ্রুত থানায় নিতে হবে ও গ্রেপ্তারের কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। কখন, কত তারিখে, কী কারণে বা কী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য কারণে এবং কোথা হতে গ্রেপ্তার হলো—তা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
(গ) এই ধারায় গ্রেপ্তারকৃতদের জন্য আলাদা ডায়েরি থাকবে থানায়।
(ঘ) গ্রেপ্তারকৃতদের শরীরে আঘাত থাকলে, আঘাতের কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে, তার চিৎসাির জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাবে ও আঘাত সম্পর্কে ডাক্তারের সনদ আনতে হবে।
(ঙ) গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতকে এর কারণ জানাবে।
(চ) বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও থেকে গ্রেপ্তার করলে গ্রেপ্তারকৃতের নিকটাত্মীয়কে টেলিফোন বা বার্তাবাহকের মারফত এক ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে।
(ছ) গ্রেপ্তারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে এবং তা অবশ্যই ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নেওয়ার আগে।
১৬৭ ধারা সংশোধনে হাইকোর্টের নির্দেশনা
(ক) ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে কাচনির্মিত বিশেষ কক্ষে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ হবে। কাচঘরের বাইরে আইনজীবী বা নিকটাত্মীয় থাকতে পারবে।
(খ) কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়া গেলে তদন্তকারী পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে আরো সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। অবশ্যই এর যথাযথ কারণ থাকতে হবে।
(গ) জিজ্ঞাসাবাদের আগে-পরে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শারীরিক পরীক্ষাসহ চিকিৎসা করাতে হবে।
(ঘ) পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড বা চিকিৎসক যদি বলেন নির্যাতন হয়েছে, তবে ম্যাজিস্ট্রেট ওই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযোগ গঠন করবেন।
(ঙ) পুলিশ হেফাজতে বা জেলে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
Leave a Reply