প্রস্তাবিত বাজেটে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য অতিরিক্ত সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ কারণে এই শিক্ষকরা তাদের পাওনা পেতে যাচ্ছেন। তবে বাজেটে বিনা বেতনে কর্মরত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের জন্য তেমন সুখবর নেই। তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও নতুন এমপিওভুক্তির দাবি মেটানো হয়নি। সেই হিসাবে এবারও এসব শিক্ষকের এমপিও পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
জানা য়ায়, অর্থ মন্ত্রণালয় বাছ-বিচারহীন নতুন এমপিওভুক্তির বিপক্ষে। শুধু তাই নয়, যেসব শিক্ষক-কর্মচারী বর্তমানে এমপিও পাচ্ছেন তাদের বিষয়টিও পর্যালোচনার পক্ষে তারা। সব মিলিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এমপিওর বিষয়ে এক ধরনের কঠোর অবস্থানে। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরাবরই বলে আসছেন, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একবার এমপিওভুক্ত করলে তার ব্যয় আজীবন বহন করতে হয়। এ কারণে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি নির্ভর করে অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তার ওপর। এবারের বাজেটে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ আছে, তাতে অনেক প্রতিষ্ঠানকেই এমপিও দেয়া সম্ভব। কিন্তু এর পরবর্তী ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাবে কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। তিনি বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত নেব।
এমপিওভুক্তির দাবিতে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে রাজধানীতে আইসিটি বিষয়ের শিক্ষকরা অবস্থান ধর্মঘট করছেন। উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বীমা বিষয়ের শিক্ষকরাও কয়েক দিন প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ফিরে গেছেন। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছেন। কয়েক বছর ধরে এমপিওভুক্তির দাবিতে বেসরকারি ৮ হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী আন্দোলন করছেন। এসব শিক্ষক-কর্মচারী বছরের পর বছর এক ধরনের বিনা বেতনে চাকরি করছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৮ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করলেই শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিও পাবেন। নতুন এমপিও খাতে বরাদ্দ মাত্র ৩১ কোটি টাকা। তাদের বিষয়টি বেশ জটিল। কিন্তু আইসিটি, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বীমা বিষয়ের শিক্ষকদের ইস্যু আলাদা। তাদের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। ২০১১ সালের এক আদেশের কারণে তারা এমপিও পাচ্ছেন না। সরকার চাইলে যেকোনো সময় এসব শিক্ষকের এমপিও দেয়ার আদেশ জারি করতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত অর্থবছরে নতুন এমপিওভুক্তি খাতে ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সেই অর্থে এসইএসডিপি প্রকল্পভুক্ত (বর্তমানে সেসিপ) পিছিয়ে পড়া এলাকার ৬৫টি স্কুল এবং আদালতে মামলায় জিতে আসা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এখনও বরাদ্দের ১৩ কোটি টাকা অব্যয়িত আছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ৮ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান নতুন এমপিওভুক্তির দাবিদার। এত প্রতিষ্ঠানকে অর্থ মন্ত্রণালয় এমপিও দিতে চায় না। তবে নতুন এমপিও নীতিমালা এবং শিক্ষা আইন প্রণীত হওয়ার পর এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে যে বন্ধ্যাত্ব বিরাজ করছে তা কেটে যেতে পারে।
সুখবর অবসরপ্রাপ্তদের : প্রস্তাবিত বাজেটে কষ্ট লাঘব হবে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৫-৩০ বছর চাকরিজীবন শেষে শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর সুবিধা’ ও ‘কল্যাণ ট্রাস্ট’ থেকে আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু এই অর্থ পেতে তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অবসর সুবিধার জন্য কোনো কোনো শিক্ষক আবেদন করেছিলেন পাঁচ বছর আগে। এরমধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছেন। কিন্তু পাওনা পাননি। তুলনামূলক সংকট কম হলেও কল্যাণ ট্রাস্ট দফতর থেকেও টাকা পেতে শিক্ষক-কর্মচারীদের দুই-তিন বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অভিযোগ আছে, এই অর্থ পেতে তদবির আর ঘুষ দিতে হয়। পরিস্থিতি এমন যে, চেক হয়ে যাওয়ার পরও ঘুষ ছাড়া তা ইস্যু করা হতো না। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে অবসর বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা, পিয়ন, ড্রাইভারের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওই দফতরে অর্থ ছাড়া ফাইল নড়ে না।
বলা হচ্ছিল, এই দুই প্রতিষ্ঠানের তহবিলে অর্থ সংকট ছিল। এ কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু এবার বাজেটে অবসর বোর্ডের তহবিলে ৫শ’ কোটি টাকার একটি সিড মানি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এ খাতে থোক বরাদ্দ হিসেবে ১শ’ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। আর কল্যাণ ট্রাস্টে ৫০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে অবসর সুবিধার জন্য ৪৪ হাজার শিক্ষক এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য ৩০ হাজারসহ মোট ৭৪ হাজার শিক্ষকের অর্থ দাবির আবেদন জমা আছে। বাজেটে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করায় এবার ভোগান্তি কিছুটা কমবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, প্রায় ২৬ হাজার এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মূল বেতনের ২ শতাংশ অর্থ কল্যাণ ফান্ডে এবং ৪ শতাংশ অর্থ অবসর সুবিধার জন্য কেটে নেয়া হতো। নতুন বরাদ্দের পর একজন শিক্ষকের এমপিও থেকে যথাক্রমে ৬ শতাংশ অবসর তহবিলে ও ৪ শতাংশ কল্যাণ ট্রাস্টে জমা দিতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, বাড়তি অর্থ কেটে নেয়ার মাধ্যমে অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের তহবিল সমৃদ্ধ করা হবে। সরকারি বরাদ্দ এবং বাড়তি কেটে নেয়া অর্থ থেকেই জমে থাকা অর্থ দাবি দ্রুত মেটানো হবে।
Leave a Reply