প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো এখন থেকে নিজেরা সরাসরি এলএলবি কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে না। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল (বিবিসি) ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ইউনিভার্সিটির জন্য মেধাতালিকা করে দেবে। সেখান থেকেই শিক্ষার্থী ভর্তি করতে হবে।
বিবিসির ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ ছাড়া কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আইন বিষয়ে অনার্স প্রোগ্রাম চালাতে পারবে না। বিদ্যমান প্রত্যেক ইউনিভার্সিটিকে এ সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে।
ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো ইউনিভার্সিটি এলএলবি কোর্স চালু করতে চাইলে আগেই ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ নিতে হবে। এই সার্টিফিকেট ছাড়া ইউজিসি আইন কোর্স চালানোর অনুমতি দিতে পারবে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছর মেয়াদি এলএলবি প্রোগ্রাম ২০২০ সাল পর্যন্ত চালানো যাবে।
দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি এবং অন্যান্য ইউনিভার্সিটির আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ে এসব নির্দেশনা ও আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, আদালতের রায়ের প্রতিলিপি গ্রহণের তিন দিনের মধ্যে বিবিসি থেকে ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ নেয়ার বিষয়ে নোটিশ করে সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাতে হবে ইউজিসিকে (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন)। পাশাপাশি আগামী ১ আগস্টের মধ্যে এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ আদালতকে জানাতে হবে।
দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি নিয়ে ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মোট ১৩টি রিট পিটিশন হাইকোর্টে দায়ের করা হয়। ওইসব মামলা একটি বেঞ্চে এনে শুনানি করা হয়েছিল। চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে বিভিন্ন কর্মদিবসে শুনানি শেষে ১৩ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। সম্প্রতি এ রায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছায়। এরপর মঙ্গলবার রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটার ক্যাম্পাসও বন্ধ ঘোষণা করেছে।
বুধবার সরেজমিন দারুলের ধানমণ্ডি ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, সাইনবোর্ড কালো কালিতে ঢেকে দেয়া হয়েছে। মিরপুর ক্যাম্পাসে গিয়ে সাইনবোর্ড পাওয়া যায়নি।
১২৬ পৃষ্ঠার রায়ের কপিতে মূল আদেশসহ দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), বিভিন্ন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বিবিসির জন্য আলাদা নির্দেশনা ও আদেশ প্রদান করা হয়। এতে সরকারের জন্য এবং আইন ডিগ্রি নিয়েও আলাদা নির্দেশনা ও আদেশ দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, এলএলবি প্রোগ্রামের বিষয়ে বার কাউন্সিলের চাহিদা ও নির্দেশনার জন্য আমরা একটি যৌথ সভা করছি। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে এটি অনুষ্ঠিত হবে। আশা করছি, আদালতের নির্দেশনা ও আদেশের আলোকে সেখানে ভালো কিছু সিদ্ধান্ত হবে।
দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি সম্পর্কিত : রায়ে এ সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি আইনের চোখে ইউনিভার্সিটি নয়। তবে এই আদালত বিশ্ববিদ্যালয়টির সনদের বৈধতা বা অবৈধতা সম্পর্কে কোনো ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছে না। এই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট পেশা এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতের চাকরিদাতার ওপর নির্ভর করবে। তারা এটা গ্রহণ করতে পারেন অথবা ‘ডিজঅনার’ করতে পারেন।
তবে যদি কোনো শিক্ষার্থী দাবি করেন যে, তিনি দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি থেকে কোনো কোর্স সম্পন্ন করে ভোগান্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তবে তিনি ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী যে ব্যক্তি বা ক্যাম্পাস থেকে সনদ নিয়েছেন, সেখানে এই ক্ষতিপূরণ চাইবেন।
আইন ডিগ্রি সম্পর্কিত আদেশ : রায়ে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে- পাঁচ ধরনের প্রতিষ্ঠানের আইন (সম্মান) ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য হবে। সেগুলো হচ্ছে : বাংলাদেশের যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি (অনার্স), বার কাউন্সিল থেকে ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ নিয়ে যেসব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এলএলবি (অনার্স) কোর্স পরিচালনা করবে, বার কাউন্সিল স্বীকৃত যে কোনো বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি (অনার্স) কোর্স, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এলএলবি (পাস) কোর্স যা ২০২০ সাল পর্যন্ত বৈধ থাকবে এবং বিদেশী এলএলবি কোর্স বা ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য অন্য যে কোনো আইনের কোর্স। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে করা দু’বছর মেয়াদি এলএলবি (পাস) কোর্স আইনের কোনো ডিগ্রি নয়।
সরকারের প্রতি নির্দেশনা : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলেন, রায়ে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির নামে দেশে যাতে আর কোনো ইউনিভার্সিটি না থাকে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এমনকি এ নামে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন না দিতে বলা হয়েছে। তবে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য বা বিভিন্ন গ্র“প মিলে ভিন্ন নামে যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চায়, সেটির অনুমোদন সরকার দেবে কিনা সে ব্যাপারেও সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাখা আছে।
ইউজিসির প্রতি নির্দেশনা : এতে ইউজিসিকে কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে- বার কাউন্সিলের কাছ থেকে আগেভাগে ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ না নিলে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এলএলবি (অনার্স) কোর্সের অনুমোদন দেয়া যাবে না। এ আদেশ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য ইউজিসি সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে নোটিশ জারি করবে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি ১ আগস্টের আগে এই আদালতে এফিডেভিট আকারে জানাতে হবে।
বার কাউন্সিলের প্রতি নির্দেশনা : রায়ে বিবিসির জন্যও আলাদা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে- ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা বিবিসি প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে। ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য আবেদনের সঙ্গে বিবিসির ব্যাংক হিসাবে অফেরতযোগ্য ১০ লাখ টাকা জমা দেবে। আবেদনের সঙ্গে বিবিসির তালিকার বাইরে আইন কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করবে না বলে অঙ্গীকারনামা দেবে। আবেদনের ৩ মাসের মধ্যে বিবিসি ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দেবে। ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট ইস্যুর আগে বিবিসি সুপ্রিমকোর্টের দু’জন মাননীয় বিচারপতিকে সংশ্লিষ্ট ইউনিভার্সিটি দেখার অনুরোধ করবে। তারা পরিদর্শনকালে ইউনিভার্সিটির কমপক্ষে ৫টি উপযুক্ত ক্লাসরুম, ১০ জন স্থায়ী পূর্ণকালীন দক্ষ শিক্ষক, সার্বিক পরিবেশ আইন শিক্ষার্থী তৈরির জন্য আদর্শ কিনা ইত্যাদি দেখবেন। যদি মাননীয় বিচারপতিরা ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করেন তাহলে বিবিসি ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট ইস্যু করবে। রায়ে একটি নমুনা ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটও দেয়া আছে।
প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিবিসি ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করবে। বিবিসি দুই বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। এসএসসি ও এইচএসসি উত্তীর্ণ আগ্রহী শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট ফরমে দুটি ছবিসহ নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আবেদন করবেন। আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষার মতো লিখিত ও এমসিকিউ পরীক্ষা নেবে বিবিসি। ভর্তি প্রক্রিয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো সুনামধারী প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সহায়তা নিতে পারবে বিবিসি। এইচএসসি বা সমমান পাস করার দু’বছরের মধ্যে শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবে। আবেদনকারীকে ইংরেজিতে ৭০ শতাংশ নম্বর প্রাপ্ত ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত হতে হবে। তবে ৭০ শতাংশের কম নম্বরপ্রাপ্তরা আইইএলটিএসে ব্যান্ড-৬ পেলে আবেদন করতে পারবে। ইংরেজি মাধ্যমের এ-লেভেল পাস করা শিক্ষার্থীরা ‘বি’ গ্রেড পেলে আবেদন করতে পারবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি নির্দেশনা : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২ বছরমেয়াদি আইন কোর্সের পরিবর্তে ৪ বছরমেয়াদি এলএলবি (অনার্স) কোর্স চালু করবে। প্রত্যেক আইন কলেজে কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণকালীন স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করবে। যেসব কলেজে ২ বছরমেয়াদি কোর্স চালু আছে, সেগুলোর স্থায়ী শিক্ষকের সনদসহ সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) তলব করবে। অনলাইন ভর্তি ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কোনো কলেজ বছরে ১০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নির্দেশনার বিষয়টি এক মাসের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংশ্লিষ্টদের জানাবে। পাশাপাশি ৩১ আগস্টের মধ্যে গৃহীত পদক্ষেপ এ আদালতকে জানাবে।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির প্রতি নির্দেশনা : রায়ে বলা হয়, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিবিসির দেয়া তালিকার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি করবে না। প্রতি শিক্ষাবর্ষে ১০০ জনের বেশি ভর্তি করবে না। দুই বছরমেয়াদি কোর্স চালাবে না। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি কোর্স আছে এবং যারা এ কোর্স চালু করতে চায়, তারা ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য বিবিসির ব্যাংক হিসাবে ১০ লাখ টাকা ফি জমা দিয়ে আবেদন করবে। আবেদনের সঙ্গে ১০ জন পূর্ণকালীন স্থায়ী শিক্ষকের সিভি জমা দিতে হবে। বিবিসির দেয়া তালিকা থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির পর তালিকা এবং পরবর্তী ডেভেলপমেন্ট প্রত্যেক বছরের ৩০ অক্টোবরের মধ্যে পাঠাতে হবে। এছাড়া আরও কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আইন কোর্স পরিচালনায় আগ্রহী প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোকে। রায়ে প্রাপ্ত ইউজিসি সচিব ড. মোহাম্মদ খালেদ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব আসমা তামকিনকে আগামী ১ আগস্টের মধ্যে জরিমানার ৫ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে তা আদালতে এফিডেভিট দাখিল করতে বলা হয়েছে। সূত্র- যুগান্তর।
সুত্র/ ল’ইয়ার্সক্লাব বাংলাদেশ ডট কম।
Leave a Reply