কী বীভৎস! ভাবা যায় না। গুলশান হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিরা এতটাই নিষ্ঠুর ও হিংস ছিল যে, মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ কয়েকজনের স্বজনকে ফোন করে মৃত্যুযন্ত্রণার শব্দ শোনানো হয়। ভিডিও কল দেয়া হয় ভারতীয় নাগরিক তারুশী জৈনের এক স্বজনকে। আর ভিডিও কলের লোমহর্ষক বর্ণনা কোনোভাবেই গণমাধ্যমে প্রকাশযোগ্য নয়।
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলায় নিহত একাধিক ব্যক্তির স্বজনরা তাদের জবানবন্দিতে এ বিষয়টি উল্লেখ করেন। তাছাড়া ঘটনার তদন্তে গঠিত যৌথ তদন্ত দলের অনুসন্ধানেও বেদনাদায়ক এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
তদন্ত দলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গুলশান হামলায় জঙ্গিরা যা করেছে, তা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘খুনের ধরন দেখে এমন ধারণা প্রকাশ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে যে, তারা অপ্রকৃতিস্থ ছিল।’ এ কারণেই নিহত জঙ্গিদের পাকস্থলী থেকে নেয়া নমুনা উচ্চতর রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, র্যাব এবং ঢাকা মেডিকেলের ল্যাবরেটরিতে ভিসেরা (৫টি ইন্ড অর্গান) লিভার, হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ও পাকস্থলীর নমুনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
জানা গেছে, গুলশান হামলায় নিহত ভারতীয় নাগরিক তারুশী জৈন জঙ্গিদের হাতে জিম্মি হন রাত পৌনে ৯টার দিকে। রাত ১০টার দিকে তাকে ব্রাশফায়ার করা হয়। গুলিবিদ্ধ তারুশী মেঝেতে পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। এ সময় জঙ্গিরা তারুশীর মোবাইল দিয়ে তার এক নিকটাত্মীয়কে ফোন করে। তারা ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা নিকটাত্মীয়কে তারুশীর প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তের যন্ত্রণাকাতর ছটফটানির শব্দ শোনায়। অপ্রকাশিত এমন নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার কথা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন তারুশীর এক নিকটাত্মীয়।
হত্যাকাণ্ডের এমন ঘটনার সময় মোবাইল ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা তার স্বজন একপর্যায়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ট্রমাটাইজড হয়ে কয়েকদিন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। যখনই তার ওই মৃত্যু আর্তনাদ ও হিংস খুনির শব্দ কানে ভেসে আসে তখন তিনি আর স্বাভাবিক থাকতে পারেন না।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তারুশীর স্বজনের দেয়া এমন তথ্যের ভিত্তিতে তারা প্রমাণ পেয়েছেন ব্যবহৃত মোবাইল সেটের ফরেনসিক পরীক্ষায়। তিনি বলেন, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কারও গল্প বানানোর কিছু নেই। কিংবা কিছুটা বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলারও সুযোগ নেই। কারণ অনেক বিষয় ও ক্লু মোবাইল সেটের ফরেনসিক পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। সেখানে উদ্ধার হওয়া ফোনসেটগুলো ফরেনসিক পরীক্ষায় কে কখন কাকে ফোনকল করেছিলেন, কী কী মোবাইল অ্যাপস নামিয়েছেন বা আদৌ নামাতে পেরেছেন কিনা সবই জানা গেছে।
সূত্র জানায়, শুধু তারুশী নন। জঙ্গিদের হাতে গুলিবিদ্ধ অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে মারা যাননি। গুরুতর আহত অবস্থায় অনেকেই মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন। এ সময় মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাদের অনেককেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায় জঙ্গিরা। রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহগুলোর ভিডিও চিত্র ধারণ করে তারা। এমনকি গুলিবিদ্ধ অনেকেই মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলে জঙ্গিরা তাদের মোবাইলের কললিস্ট থেকে স্বজনদের নম্বরে ফোন করে।
মোবাইল ফোনে তাদের যন্ত্রণাকাতর আর্তচিৎকারের শব্দও শোনানো হয়। কয়েকজন বিদেশীর স্বজনকে ভিডিও কলও দেয় জঙ্গিরা। রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকা কয়েকজন নারীর দেহের ওপর পা তুলে রীতিমতো ফটোসেশন করে কয়েকজন জঙ্গি। বর্বরতার এখানেই শেষ নয়। এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছবিগুলো গণমাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে ব্যস্ত ছিল জঙ্গিরা। রক্তভেজা ফ্লোরে দাঁড়িয়ে অনেকটা উল্লাস প্রকাশ করে ছবিগুলো পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের মুখপাত্র আমাক ও দাবিকের ওয়েবসাইটে। সেখান থেকে এসব নৃশংস ছবি নিয়ে একের পর এক প্রকাশ করতে থাকে আমেরিকায় অবস্থানরত ইসরাইলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট রিটা কার্টৎজ।
ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের হাতে আসা এমন একটি ছবিতে দেখা যায়, জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ নৃশংসভাবে নিহত তারুশী জৈনের রক্তাক্ত নিথর দেহের ওপর পা তুলে ছবি তুলেছে। সেলফি স্টাইলে তোলা ওই ছবিতে রোহান শুধু লাশ ও তার পায়ের ওপর ক্যামেরা ফোকাস করে। ফলে ছবিতে রোহানের চেহারা আসেনি। তবে রোহানের অন্য ছবির সঙ্গে তার পরনের পোশাক মিলিয়ে ‘নৃশংতার প্রতীক’ ‘ওই পা’টিকে ‘রোহানের পা’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
হাসনাত করিমকে নিয়ে গোলক ধাঁধা : এদিকে হলি আর্টিজানে যখন হত্যাকাণ্ডের চরম বর্বরতা আর নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল, তখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম ছিলেন অনেকটাই স্বাভাবিক। এমনকি তিনি তার স্মার্ট ফোন ও ট্যাব দিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত গুলশান হামলা সংক্রান্ত সংবাদ মনিটর করছিলেন। হামলার সময় তিনি তার চাচা আনোয়ারুল করিমকে ১০টা ৪১ মিনিটে ফোন করেন।
সূত্র জানায়, হাসনাত যে মোবাইল ফোন দিয়ে তার চাচার সঙ্গে কথা বলেন, সেই ফোনটি তিনি কেনেন গত বছর জুলাইয়ে। গত বছর জুলাই থেকে চলতি বছরের পহেলা জুলাই হামলার দিন পর্যন্ত তিনি মাত্র তিনবার চাচার কাছে ফোন করেন।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ তাকেই ফোন করে, যিনি তার সবচেয়ে কাছের মানুষ এবং যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেশি। বিশেষ করে যিনি তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন।’ কিন্তু তার প্রোফাইল স্টাডি করে দেখা গেছে, তিনি ওই সময় বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে সমাজের অনেক হাইপ্রোফাইল লোকজনকে ফোন করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি।
আবার ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, হাসনাত করিম ঘটনার সময় তার ফোনসেট দিয়ে কোনো অ্যাপস নামাননি। উইকার নামক অ্যাপস নামানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নামাতে পারেননি। যদিও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে আগে বলা হয়, হাসনাত করিম উইকার ও থ্রিমা নামে দুটি অ্যাপস ডাউনলোড করে জঙ্গিদের সহায়তা করেছিলেন।
গোয়েন্দা সংস্থার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত হাসনাত করিমের বিরুদ্ধে এ ঘটনায় সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হবে। কেননা হাসনাত করিমের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় যে রিপোর্ট এসেছে তাতে তাকে আইনি কাঠামোর মধ্যে ধরে রাখা সহজ হবে না। সেক্ষেত্রে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজনে তাকে শেষমেশ ৫৪ ধারায় আটক দেখানো হতে পারে।
উল্টো মোটিভেটেট হওয়ার আশংকা : জঙ্গি সন্দেহে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে একটি গ্রুপকে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিয়ে বিপাকে পড়ছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এমন একজন কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় কিছু জঙ্গি এমন আচরণ করেন যে, তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য বের করা তো দূরের কথা, উল্টো নিজেরাই মোটিভেটেট হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়। কোনো কৌশল ব্যবহার করে তাদের কাছ থেকে তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যত রকম প্রেসার দেয়া হোক না কেন তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র টলানো যায় না।
বরং জিজ্ঞাসবাদের সময় তারা ধর্মীয় এমন সব বক্তব্য তুলে ধরেন যা শুনিয়ে উল্টো তারা আমাদের মোটিভেটেট করার চেষ্টা করে। ফলে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো জঙ্গির কাছ থেকে কোনো তথ্য বের করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, জিজ্ঞাসাবাদের সময় এসব হোমমেড জঙ্গিরা এমন অনেক কিছুই বলে, যা তদন্ত ও জনস্বার্থে তারা গণমাধ্যমে তুলে ধরতে চান না।
Leave a Reply