আমরা বলি, এই আগস্ট মাস শোকের মাস। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অতর্কিত এবং অকস্মাত্ সেনাবাহিনীর কয়েকজন দুর্বৃত্ত সদস্য তাকে হত্যা করে। সেই সঙ্গে আরো কয়েকজন রাজনীতিবিদ এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সব সদস্যকে, যাকে তারা সেদিন পেয়েছে, এমনকি আট বছরের শিশু বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র রাসেলকে তারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। এরা যে কত ঘৃণ্য কাপুরুষ তা ইতিহাসে সংযুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে স্বাধীনতার শত্রুরা।
এরা স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই পরাজিত পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাদের দোসর আলবদর, রাজাকাররা এবং সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ মিলিত হয়ে একটি নীল নকশার মাধ্যমে ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছে। তাঁকে হত্যা করা ছিল একটি সংঘবদ্ধ আক্রমণের অংশ। তারা শুধু শেখ মুুজিবুর রহমানকে হত্যা করেনি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা যা বঙ্গবন্ধু এনে দিয়েছেন।
১৫ই আগস্টের সেই দিন আমি খুব ভোরবেলায় জেগে যাই। আমার স্ত্রী পারভীন হাশেম আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি ওঠো। সর্বনাশ থেকে গয়ে গেছে আমাদের। বেতারে কী বলছে শোনো। আমি শুনলাম, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। কুখ্যাত শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি যে দুঃশাসন-কুঃশাসন চালিয়েছিলেন তা থেকে জনগণ মুক্তি পেয়েছে। দেশবাসী আপনারা শান্ত থাকুন। বীর সেনাবাহিনীর হাতে এখন ক্ষমতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন রাষ্ট্রপতি দেশবাসীর কাছে বক্তব্য রাখবেন। … বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এই ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শুনেই আমি চমকে ওঠলাম। আমাদের ‘জয় বাংলা’ তাহলে কোথায় গেল? আবার কি দেশটা পাকিস্তান নিয়ে গেল?
অনেকদিন পরে আমি স্মরণ করছি সেই দিনটির কথা। বিষয়টি হুবহু ঠিকই আছে, শুধু ভাষা ও শব্দ চয়ন এদিক-সেদিক বা পরিবর্তিত হতে পারে। সেইদিন ওই কথার পরপরই শুনলাম রেডিওর ঘোষক বলছে, ‘রেডিও বাংলাদেশ। এখনই আপনারা পরবর্তী ঘোষণা শুনবেন। এরপরই অনেক কিছু শুনলাম। তারপরই আমার মনে হলো, স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং ২৩ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের যা অর্জন হয়েছিল; স্বাধীন বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, স্বাধীনতা, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা— বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সবকিছুকেই হত্যা করা হলো। তারা আমাদের সম্মিলিত শক্তির উচ্চারণ স্বাধীনতার শব্দঅস্ত্র ‘জয় বাংলা’কে হত্যা করলো। ‘বাংলাদেশ বেতারের’ জায়গায় চলে এলো ‘রেডিও বাংলাদেশ’। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-র মতো ‘জিন্দাবাদ শব্দটি বসিয়ে দেওয়া হলো।
সেই সময় আমি দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষকে এই বিষয়টি বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। আমার দুঃখ অনেকেই বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি। যত দিন গিয়েছে, এরপর যারা পরবর্তী ২০ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মুছে দিতে আমাদের অর্জনকে বিকৃত করেছে। তারা বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার শত্রু, আলবদর, জামায়াত ও রাজাকারকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসিয়ে পুরো জাতি ও স্বাধীনতাকে অপমানিত করেছে।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সরকার ফিরে পেয়েছি। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণ মুক্তি ও সমৃদ্ধির পথ দেখেছে।
লেখক:চিত্রশিল্পী
Leave a Reply