“এমনিতেই বান আর ভাঙনের যন্ত্রণা তার ওপর আবার পোলাপাইন জ্বালায়। ঘরে খাওন নাই, ওনার কাম নাই। বাপের বাড়ি যাইমু এহন টলারও নাই। হগল বিপদ একলগে আইছে। আল্লাহ আমাগোরে বিপদ থেইকা রক্ষা কর।” ৪ বছরের কন্যাসন্তান সিনথিয়ার হাত ধরে আর আড়াই বছরের পুত্র সন্তান তামিমকে কোলে নিয়ে পদ্মা নদীর তীরে দাড়িয়ে একথাগুলো বলছিলেন মা কল্পনা।
অথৈ পদ্মার প্রতিটি ঢেউ যেন কল্পনার হৃদয়ে আঘাত হানে। বিষন্নতার ছায়া দেখা যায় কল্পনার চোখ মুখে। তবুও কল্পনার দৃষ্টি পদ্মার খড় স্রোতের দিকে। মনে হচ্ছে কল্পনা পদ্মার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। তবে কল্পনাকে দুর্বল মনে হচ্ছে না।
কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে কল্পনা বলেন, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ইয়াকুব মাতব্বর কান্দির দিন মজুর ছলেমান মাতব্বরের স্ত্রী আর একই ইউনিয়নের বাবুরচর এলাকার গিয়াস উদ্দিন বেপারীর মেয়ে কল্পনা। স্বামী ও পিতার বাড়ির মধ্যে সর্বনাশা পদ্মা নদী। কল্পনার ২৩ বছরের জীবনে এ বারসহ ৪ বার নদী ভাঙন দেখেছে। তবে এবারের নদী ভাঙন একেবারেই আলাদা। নদী ভাঙনের সাথে বন্যা আর কখনও তিনি দেখেন নাই।
স্বামীর বাড়ি পদ্মা নদীর ভাঙনের কবল থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিতে হবে সে ক্ষেত্রে শিশু সন্তান সিনথিয়া ও তামিম বাঁধা তাই সন্তানদের পিতার বাড়িতে মায়ের কাছে নিরাপদে রেখে আসবে। এ জন্যই পদ্মা নদীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পদ্মার পাড়ে ট্রলার আসবে আর কল্পনা সন্তানদের নিয়ে পদ্মার বান ও ঢেউ উপেক্ষা করে পিতার বাড়ি বাবুরচরে যাবে। পিতার বাড়িতেও বানের পানি ঘরের চাল ছুঁই ছুঁই তবে নদী ভাঙনের ভয় নাই। ইতিমধ্যে তিন বার পিতার বাড়ি সরিয়ে এখন ভাঙন মুক্ত এলাকায় রয়েছে। কিন্তু নাড়িছেঁড়া ধন সন্তানদের পানিতে ভাসিয়ে পিতার বাড়িতে রেখে কল্পনা কিভাবে থাকবে?
কল্পনার মুখটা শুকনো আর বাচ্চাদের পড়নে ময়লা পোষাক সে দিকে কল্পনার নজর নাই। নজর শুধু কখন ট্রলার আসবে। এমনিভাবে পদ্মা নদীর তীরবর্তী মানুষের প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। কল্পনাও সে সকল মানুষের মধ্যে একজন প্রকৃতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ যোদ্ধা ও টিকে থাকা বীর। কোন ধরণের দুর্বলতা, সন্তানদের জন্য মায়া বা ভয় কল্পনার হৃদয়ে পদ্মা নদীর মতো আঘাত হানতে পারেনি।
Leave a Reply