এ যেন এক নীরব বিপ্লব। শিক্ষার দৌড়ে দারুণভাবে এগিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এক দশক আগেও দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল কম। প্রতি ১০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ জনের মধ্যে। এখন তা ৫১ ছাড়িয়েছে। প্রাথমিকে ছেলেদের শতকরা হার এখন ৪৯ ভাগ। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় তো আরও চমক। সেখানে বর্তমানে পাঠগ্রহণকারী মেয়েদের সংখ্যা শতকরা ৫৩ ভাগ। আর ছেলে ৪৭ ভাগ। কেবল প্রাথমিক আর মাধ্যমিক নয়, উচ্চশিক্ষা স্তরেও মেয়েরা এখন ছেলেদের ছুঁই ছুঁই করছে, শতকরা ৪৫ ভাগ। এ তথ্য জানিয়েছে ‘বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো’ (ব্যানবেইস)।
ব্যানবেইসের পরিচালক মো. ফসিউল্লাহ রোববার সমকালকে জানান, কেবল সংখ্যাগত নয়, পরীক্ষার ফলের দিক থেকেও মেয়েরা অনায়াসে এখন পেছনে ফেলছে ছেলেদের। নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ এখন বিশ্ব উদাহরণ। এ দেশ আশপাশের অনেক দেশের জন্য রীতিমতো মডেল হতে পারে।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, ‘বাংলাদেশ বদলে গেছে। সাধারণ মানুষ হয়তো তা বুঝতে পারেনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা লিঙ্গ সমতা অর্জন করেছি। সামাজিকভাবে এত বড় অর্জন আর হয়নি। আমি বলব, নারী শিক্ষায় এক সামাজিক বিপ্লব ঘটে গেছে।’
মন্ত্রী জানান, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও মেয়েরা এখন ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে (মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বাদে) ছাত্রীদের সংখ্যা ছাত্রদের চেয়ে এখন বেশি, ৫১ ভাগ প্রায়। সুবিশাল এই অর্জনকে খাটো করে দেখার আজ আর কোনো অবকাশই নেই। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশও এটা পারেনি।
জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৪’-এ প্রাথমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের (এনরোলমেন্ট) সূচকে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের সূচকেও এই অঞ্চলের প্রথম সারির ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ প্রতিবেদনে নারীশিক্ষায় ১৩৬টি দেশের মধ্যে ১১৫তম অবস্থান থেকে বাংলাদেশ ১১১তম অবস্থানে উঠে এসেছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, আমার সঙ্গে কোনো মেয়ে পড়েনি। আর আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। প্রতিটি বিদ্যালয়ের ক্লাস আজ মেয়েদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ। বরং সংখ্যায় তারা ছেলেদের চেয়েও বেশি। দীর্ঘদিনের পশ্চাৎপদতা, অবহেলা আর বঞ্চনার দেয়াল ভেঙে মেয়েরা বেরিয়ে আসতে পেরেছে, এর চেয়ে বড় অর্জন আর কিইবা হতে পারে!
ব্যানবেইস সর্বশেষ (২০১৫ সাল) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, তার মধ্যে ৫১ দশমিক ১ শতাংশ ছাত্রী। বাকিরা ছাত্র। সংখ্যার হিসাবে প্রাথমিকে এখন ১ কোটি ১০ লাখ ৪ হাজার ২০ জন ছাত্রী পড়াশোনা করছে। আর ছাত্র পড়ছে ১ কোটি ৪ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৩ জন।
ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীর সংখ্যা আরও বেশি; ৫৩ শতাংশ। আর ছাত্র ৪৭ শতাংশ। মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় পাসের হারেও ছাত্রীরা প্রতি বছর এগিয়ে চলছে। ২০০৯ সালে যেখানে ছাত্রীদের পাসের হার ছিল ৬৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, সেখানে ২০১৬ সালের পরীক্ষায় ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ বেশি পাস করেছে। ছাত্রদের পাসের হার ৮৮ দশমিক ২০ ও ছাত্রীদের ৮৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অবশ্য গত কয়েক বছরে মোট পাসের হারও বাড়ছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী সমকালকে বলেন, সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার যদি থাকে, তবে যে কোনো বড় অর্জন করা সম্ভব। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নারীশিক্ষার সমতা অর্জনের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছে। আর একটি বিষয় হলো, ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। এক সরকারের ভালো কাজ অপর সরকার এসে বন্ধ না করা। তিনি বলেন, আগে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা অবৈতনিক ছিল। নব্বইয়ের পর বিএনপি সরকার প্রথম মেয়াদে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের অবৈতনিক করল। আওয়ামী লীগ সরকার ‘৯৬ সালে এসে সেটাকে প্রথমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত করল। এখন ডিগ্রি (পাসকোর্স) পর্যন্ত নারীশিক্ষা অবৈতনিক। এর মধ্যে চালু করা মেয়েদের উপবৃত্তি এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। এ ছাড়া শিক্ষার প্রতি জনমানুষের মধ্যে বিরাট চাহিদা তৈরি হয়েছে। এটাও কাজে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, গত মহাজোট ও বর্তমান সরকার সম্মান কোর্স চালু, পাঠ্যক্রম সংশোধনসহ মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে এখন মাদ্রাসায়ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
নারীশিক্ষার এই গতি আরও ত্বরান্বিত করা সম্ভব জানিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নিরাপত্তার অভাবের কারণে এখনও অনেক মেয়েকে গ্রামে-গঞ্জে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের উচিত হবে নিরাপত্তা জোরদার করা এবং সচেতনতা বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম ভিত্তিই হলো শিক্ষা। আর সেই ভিত্তিটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। চ্যালেঞ্জিং সব কাজে নারীদের অংশগ্রহণ আজ দৃশ্যমান। এই অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখছে।
Leave a Reply