একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। গতকাল শনিবার গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয় বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক জানিয়েছেন। এ নিয়ে ছয়জন মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হলো। তাঁদের পাঁচজন জামায়াতে ইসলামীর এবং একজন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা।
পাঁচজনেরই ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কাশিমপুর কারাগারে প্রথম কোনো যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হলো। গত রাত সাড়ে ১২টার দিকে মীর কাসেমের লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স কাশিমপুর কারাগার ছেড়ে মানিকগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়।
সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, শাজাহানের নেতৃত্বে চারজন জল্লাদ কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী এই অপরাধীর লাশ প্রায় ২০ মিনিট ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর মরদেহ ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয়। গাজীপুরের সিভিল সার্জন আলী হায়দার খান মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরে লাশের সুরতহাল করা হয়।
দণ্ড কার্যকরের সময় আইজিপি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর জেলার নাশির আহমেদ, জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম, পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ, সিভিল সার্জন আলী হায়দার খান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে লাশবাহী তিনটি অ্যাম্বুলেন্স কারাগারে নিয়ে রাখা হয়।
কারা সূত্র জানায়, কারাগারে মীর কাসেমকে শেষ গোসল করানো হয়। তাঁকে তওবা পড়ান কারাগার মসজিদের ইমাম মুফতি হেলাল উদ্দীন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি জামায়াতের অর্থের জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন কেয়ারি গ্রুপের মালিক এবং ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, দিগন্ত মিডিয়াসহ বেশ কিছু ব্যবসায়িক উদ্যোগের উদ্যোক্তা ও অংশীদার। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাসপাতাল, ভবন নির্মাণপ্রতিষ্ঠান, পরিবহন, গণমাধ্যমসহ অনেক কিছুই রয়েছে।
২০১২ সালের ১৭ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর থেকেই কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন মীর কাসেম। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসি ও আটটি অভিযোগে কারাদণ্ড হয়। এরপর তাঁকে কারাগার-২-এর ৪০ নম্বর কনডেমড সেলে স্থানান্তর করা হয়। সর্বশেষ সেখানেই ছিলেন তিনি।
গতকাল সকালে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর পরিবারকে দেখা করার জন্য বেলা সাড়ে তিনটায় আসতে বলে। ৩টা ৪০ মিনিটে ছয়টি গাড়িতে আসা পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাতের জন্য কারাগারে ঢোকেন। কারাগারের একটি সূত্র জানায়, ছয়টি গাড়িতে ৪২ জন সাক্ষাতের জন্য এসেছিলেন। ভেতরে ঢুকে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সোয়া চারটায় তাঁদের ২২ জন মীর কাসেমের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। সাক্ষাৎ শেষে পৌনে সাতটার দিকে তাঁরা কারাগার থেকে বেরিয়ে যান।
এ সময় মীর কাসেমের স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মীর কাসেম মৃত্যুভয়ে ভীত নন। তবে তিনি আক্ষেপ করেছেন যে ছেলেটার সঙ্গে তাঁর দেখা হলো না।’ পরে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মোট ২২ জন দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। কয়েক ভাগে ভাগ করে তাঁদের দেখা করানো হয়। প্রথমে একটু দূরসম্পর্কের আত্মীয়রা দেখা করেন। পরে তিনি ও তাঁর দুই মেয়ে, পুত্রবধূসহ আটজন দেখা করেন। দেখা করার সময় শেষ ইচ্ছা হিসেবে ছেলের দেখা না পাওয়ার কথা বারবারই বলছিলেন মীর কাসেম আলী। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপও রয়েছে।
ফাঁসির প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকে কাশিমপুর কারাগারের চারপাশে এবং কারাফটকের সামনে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোনাবাড়ী থেকে ঢোকার মুখে রাস্তার দুই পাশের সব দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিকেলের পর থেকে গণমাধ্যমের গাড়ি ছাড়া আর কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। সন্ধ্যার পর ভিড় করা আশপাশের বাসিন্দা ও উৎসুক মানুষকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
জেলা পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলের আশপাশে মোতায়েন ছিলেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে কারাগারে ঢোকেন আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখার উদ্দীন।
দুপুরের পরে ফাঁসি কার্যকরে সরকারের নির্বাহী আদেশ কারাগারে পৌঁছায়। কাশিমপুর কারাগার-২-এর কারাধ্যক্ষ (জেলার) নাশির আহমেদ গতকাল বিকেলে বলেন, ফাঁসি কার্যকরের জন্য যে নির্বাহী আদেশ প্রয়োজন, তা কারাগারে এসেছে।
২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে তাঁকে ফাঁসির আদেশ ও আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড: আপিল বিভাগের রায়ে ১১ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এই অভিযোগের বর্ণনা অনুসারে, একাত্তরে ঈদুল ফিতরের পরের যেকোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁকে সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলেও আরও পাঁচজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশসহ তাঁর মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম। চলতি বছরের ৮ মার্চ আপিলের রায়ে ১৯৭১ সালে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। অন্য ছয়টি অভিযোগে তাঁর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড বহাল রাখেন আদালত। আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ৬ জুন প্রকাশিত হওয়ার পর রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাসেম। এরপর গত ৩০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। এর মধ্য দিয়ে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়।
শেষ সুযোগ ছিল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন। কিন্তু সেই সুযোগ মীর কাসেম গ্রহণ করেননি।
Leave a Reply