স্বামীর সঙ্গে ট্রেনে চড়ে এই প্রথম জামালপুরে শ্বশুরবাড়িতে যাবেন নববধূ আসমা খাতুন (১৯)। চলন্ত ট্রেনের জানালায় বসে দু’জন সুদূরে তাকিয়ে থাকবেন। দেখবেন প্রাকৃতিক দৃশ্য। মাঝে মাঝে মাতবেন খুনসুটিতে। শাশুড়ি, ননদ আর দেবররা তার পথ চেয়ে আছেন। মজা করে তাদের সঙ্গে ঈদ করবেন- এমন আরও কত স্বপ্ন আসমার! আর তা সত্যি হতেও চলছিল। শনিবার স্বামীর সঙ্গে বের হন ট্রেন ধরতে। কিন্তু একটা বিস্ফোরণ তার সব স্বপ্ন মুহূর্তে চূর্ণ করে দিল। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া হল না তার। শনিবার টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীর টাম্পকো ফয়েলস লিমিটেডে ব্রয়লার বিস্ফোরণে ধসে পড়া ভবনের নিচে পড়ে প্রাণ হারান নববধূ আসমা। ইট-বালু আর সুরকিচাপায় স্বামীর সামনেই করুণ মৃত্যু হয় তার। অল্পের জন্য বেঁচে যান স্বামী সুমন। স্ত্রীর মৃত্যুতে সুমনের আর্তনাদ উপস্থিত সবাইকে কাঁদিয়েছে। সুমন জানান, তাদের বিয়ের বয়স মাত্র ৪০ দিন। অল্প দিনের সঙ্গী তাকে নিঃসঙ্গ করে চলে গেল না-ফেরার দেশে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, আসমার বাবা আবদুল মতিন ভ্যানে সবজি বিক্রি করেন। বাসা টঙ্গীর দক্ষিণ মিরাশপাড়ায়। এখানে ভাড়া থাকেন। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। আসমার মা অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। তখন আসমা খুব ছোট। তার বাবা মতিন দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় সংসারে মতিনের চার মেয়ে। চার মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। আসমা গার্মেন্টে কাজ করতেন। পারিবারিকভাবে ৩০ জুলাই দক্ষিণ মিরাশপাড়ার ভাড়াবাসায় বাস করা গার্মেন্ট কর্মী সুমনের সঙ্গে আসমার বিয়ে হয়। বিয়েতে সুমনের বাবা উপস্থিত ছিলেন। সুমনের মা, ভাই ও স্বজনরা গ্রামের বাড়ি জামালপুর থেকে আসতে পারেননি। সুমনের খালাতো ভাই ও ভাবিরাও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। তারা মিরাশপাড়াতেই থাকেন।
সুমনের খালাতো ভাই আলাল জানান, সুমন মিরাশপাড়ায় একটি ওয়াশিং কারখানায় কাজ করেন। তিনি একাই মিরাশপাড়ায় থাকেন। বাবা-মা থাকেন গ্রামের বাড়ি জামালপুর। বাসা ভাড়া করে স্ত্রী নিয়ে সংসার শুরু করেন সুমন। তাদের দু’জন দুটি কারখানার শ্রমিক। তাই ছুটি না থাকায় বিয়ের পর স্ত্রী আসমা শ্বশুরবাড়ি যেতে পারেননি। ঈদ উপলক্ষে যাওয়ার কথা ছিল তাদের।
সুমন বলেন, ‘আমার স্ত্রী আমাদের গ্রামের বাড়ি যাবে, এজন্য খুব আনন্দ করছিল। ক’দিন ধরে সে অস্থির হয়ে উঠছিল কবে ছুটি হবে, কবে শ্বশুরবাড়ি যাবে। ও বলত, আমরা ট্রেনে করে যাব অনেক মজা হবে।’ সুমন জানান, ঈদ উপলক্ষে তিনি স্ত্রীর জন্য একটি নতুন কালো রঙের থ্রি-পিস, একজোড়া হিল ও কসমেটিকস কিনেছিলেন। তার স্ত্রী শ্বশুরের জন্য লুঙ্গি, গেঞ্জি আর শাশুড়ির জন্য একটি শাড়ি কিনেছিলেন।
সুমন কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ি যাবে, এজন্য অনেক সাজগোজ করে সে। শুক্রবার রাতে হাতে মেহেদি দেয়। দু’হাত রাঙিয়ে আমাকে বলে, কেমন লাল হয়েছে বলো। শনিবার ভোরে বাসা থেকে বের হতে হবে- এজন্য রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রাখে সে। ভোরে নতুন জামা পরে আমরা বের হই জামালপুরের উদ্দেশে।’ বলতে বলতে সুমনের গলা ধরে আসে।
চোখের পানি সামলে নিয়ে সুমন আরও বলেন, আমার হাতে ব্যাগ ছিল। টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠব। ট্রেনের আগাম টিকিটও কাটা ছিল। জানালার পাশেই দু’জনের পাশাপাশি আসন। বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা না পেয়ে হাঁটা শুরু করি। কিছ্ক্ষুণ হাঁটার পর ও পেছনে পড়ে যায়। আনুমানিক চারফুট পেছনে। ও টাম্পকো ফয়েলস লিমিটেডের ভবন পার হচ্ছিল। এমন সময় বিকট শব্দ শুনতে পাই। পেছন ফিরে দেখি ভবন ধসে আমার স্ত্রীর ওপর পড়েছে। ইট ছিটকে আমার গায়েও লেগেছে।
এ সময় সুমনের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে ইট সরিয়ে আসমাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে। দ্রুত টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে তার লাশ মিরাশপাড়ার বাসায় নেয়া হয়। বিকাল ৩টার দিকে আসমার লাশ গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের উদ্দেশে নেয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সে স্ত্রীর লাশের পাশে আর্তনাদ করতে থাকেন সুমন, ‘ও আমাকে নিঃসঙ্গ করে চলে গেল।’
Leave a Reply