বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক তিনটি সংক্রমণ ব্যাধি এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে একত্রে কাজ করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শুক্রবার কানাডার মন্ট্রিয়েলে অনুষ্ঠিত ফিফথ গ্লোবাল ফান্ড (জিএফ) রিপ্লেনিসমেন্ট কনফারেন্সের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধযোগ্য ও এসব রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন অঙ্গীকার, সংকল্প ও সংহতি। একত্রে কাজ করার এই অঙ্গীকার এই ব্যাধির অবসান ঘটাতে পারে।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেশের সকল জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের প্রচেষ্টায় বৈশ্বিক তহবিলের সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অবকাঠামো, স্বাস্থ্যপণ্য ও সেবায় বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে আমার সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টায় আমরা বৈশ্বিক তহবিলের সহায়তা আশা করছি।
এইডস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সম্পর্কিত কার্যক্রমের জন্য প্রধান অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গ্লোবাল ফান্ড। এই তহবিলের সহায়তা কার্যক্রম গোটা বিশ্বব্যাপী, এর মূল লক্ষ্য বিশ্বের সেই সব এলাকা যেখানে এসব রোগব্যাধি বড় বোঝা হয়ে আছে।
উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ দিক’ হিসেবে বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সমাজের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা অত্যন্ত জরুরি।’
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে দরিদ্র্য দূরীকরণের ওপর, খাদ্য নিরাপত্তা এবং এমনকি জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা… সুষম উন্নয়ন সব চ্যালেঞ্জ নির্ভর করে সক্ষম ও টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব আজ উন্নয়ন প্রত্যাশার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দরিদ্র্যমুক্ত সবল একটি বিশ্ব সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০১৫ সালে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করেছি।’
তিনি বলেন, সক্ষমতা ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্যসমূহসহ এমডিজি’র লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, গত দুই দশকে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ কমেছে এবং পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মৃত্যুহার ৬৬ শতাংশ ও গত দেড় দশকে নবজাতকের মৃত্যুহার ৬২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
তিনি বলেন, তাঁর সরকারের কার্যকর নীতি ও বাস্তবসম্মত কার্যক্রম গ্রহণের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ২০২০ সাল নাগাদ ম্যালেরিয়া নির্মূলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং গত দু’দশক ধরে এইচআইভি/এইডস প্রাদুর্ভাবের নিম্ন হার বজায় রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০৪ সাল থেকে প্রায় ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করেছি এবং এর মধ্যে ৯৪ শতাংশ রোগীর সফলভাবে চিকিৎসা করা হয়েছে। আমরা এই সাফল্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’
বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে বালিকা ও নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের অঙ্গীকার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনটি বিষয় চিহ্নিত করেন।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার নারীর ক্ষমতায়নের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। তিনি আরো বলেন, আমরা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের উপবৃত্তি চালু করেছি। এর ফলে তাদের স্কুলে উপস্থিতির হারই শুধুমাত্র উল্লেখযোগ্য, উন্নতি হয়নি নাবালিকা বিয়ে এবং মা ও শিশু মৃত্যুহারও হ্রাস পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্বিতীয়ত, সহিংসতার ফলে নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য গম্ভীরভাবে প্রভাবিত হয়। তাই আমরা নারীর বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের সহিংসতা ও বঞ্চনার ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছি।
তিনি বলেন, তৃতীয়ত, তার সরকার দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১৬ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছে। এই ক্লিনিকগুলোর কর্মীদের অধিকাংশই নারী এবং এইসব কেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত শক্তিশালীকরণে গ্লোবাল ফান্ডসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উল্লেখযোগ্য অবদানের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, গ্লোবাল ফান্ড বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে যা মূলতঃ ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও এইচআইভি আক্রান্তদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করছে।
এর আগে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণদানের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে উপস্থাপক এবং কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও ফ্রাঙ্কোফোনি বিষয়ক মন্ত্রী মেরির ক্লদ বিবে বলেন, শেখ হাসিনাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই ‘তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্তম্ভ’।
উল্লেখ্য, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এইসব মরনঘাতি রোগের মহামারী নির্মূলে তহবিল সংগ্রহের লক্ষে এই সম্মেলনের আয়োজন করে কানাডা।
আয়োজকদের মতে, এই সম্মেলন বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক তিনটি রোগ এইডস, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মহামারী নির্মূল করতে সারা বিশ্বের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছে।
Leave a Reply