শঙ্কার নগর নারায়ণগঞ্জে নজিরবিহীন শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে মেয়র পদে বিপুল ভোটে পুনরায় বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভী। বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের যত নির্বাচন হয়েছে এর সব কটিতেই মৃত্যু ও লাশের মিছিল ছিল দীর্ঘ।
ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে ওই সব নির্বাচন সম্পন্ন হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয় নির্বাচনী সহিংসতা ঠেকাতে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ভোটের ফল প্রকাশে নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষাবলম্বন করেছে। ফলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি বিরোধীদের আস্থা ছিল শূন্যের কোঠায়। সেই নির্বাচন কমিশনই মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ ছিল না কোনো। অভিযোগ ছিল না আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষ থেকেও।
১৭৪ ভোটকেন্দ্রের সব কটির ফলাফলে আইভী পেয়েছেন এক লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট এবং সাখাওয়াত পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট।
জয় নিশ্চিত হওয়ার পর গতকাল রাত পৌনে ১০টার দিকে নিজের বাসভবনে আইভী সাংবাদিকদের বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ আমার প্রতি যে আস্থা রেখেছে আমি সেই আস্থার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করব। আমি মানুষের পাশে ছিলাম, মানুষের পাশেই থাকব। ’
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ভোট শুরু হয়ে চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। নির্বাচনী এলাকার কোথাও সারা দিনে উল্লেখযোগ্য অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের সুধীসমাজের মতে, নাসিক নির্বাচন যেভাবে সম্পন্ন হলো তা সারা দেশের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনো ধরনের বাধা ছিল না। শঙ্কার এই নগরে অভূতপূর্ব শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে তাই দুই প্রার্থীই খুশি।
রিটার্নিং অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে জানান, আগামীকাল ২৪ ডিসেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত বন্দরনগরীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ থাকবে।
এবার নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী ছিলেন সাতজন। তবে এঁদের মধ্যে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন নৌকা প্রতীকের ডা. সেলিনা হায়াত আইভী এবং ধানের শীষের অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। নাসিকের ২৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৫৬ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৮ জন প্রার্থী ছিলেন। চার লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১ ভোটারের জন্য ১৭৪টি কেন্দ্রে এক হাজার ৩০৪টি বুথ ছিল। মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ৩৯ হাজার ৬৬২ জন এবং নারী দুই লাখ ৩৫ হাজার ২৫৯ জন।
সকাল সাড়ে ৯টায় ডা. সেলিনা হায়াত আইভী ভোট দিয়েছেন নগরের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দেওভোগে শিশুবাগ কেন্দ্রে। আর সকাল ৮টায় সাখাওয়াত হোসেন ভোট দিয়েছেন ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাসদাইর আদর্শ স্কুলে।
শান্তিপূর্ণ নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি কম : নির্বাচনে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি ও টল ছিল দেখার মতো। ভোটারদের নিরাপদে ভয়হীন পরিবেশে ভোটদানে উৎসাহ দিতে নির্বাচন কমিশনের সব প্রস্তুতি থাকলেও ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অজানা একটি ভয় থেকে ভোটাররা কেন্দ্রে যায়নি। এ ছাড়া ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের উৎসাহও ছিল কম।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ভোটার পৌনে পাঁচ লাখ। রিটার্নিং অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে জানান, ৬২ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর আগে ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৯.৯২ শতাংশ। গতবার ভোটার ছিল চার লাখ চার হাজার ১৮৯ জন। সে তুলনায় এবার ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে।
গতকাল ভোট শুরু হওয়ার আগেই বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে বিপুলসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি দেখা যায়। তবে দুপুর নাগাদ কেন্দ্রগুলো অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়।
৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে স্থানীয় সরকারের যত নির্বাচন হয়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিরোধী দল ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ায় এ নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগেরও দাবি করেছেন বিএনপির নেতারা। কিন্তু সব শঙ্কা উড়িয়ে গতকাল নাসিক নির্বাচন অভূতপূর্ব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের পক্ষ থেকে ভোট অনুষ্ঠান ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের কোনো অভিযোগ নেই। তবে সাখাওয়াত হোসেন খান গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। ভয়ভীতির কারণে ভোটাররা ভোট দিতে কম এসেছে। তিনি আরো বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে। আমরা চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ও সঠিক ভোট গণনা। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যেকোনো রায় আমরা মেনে নেব। ’ ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে ধানের শীষ বিজয় অর্জন করবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। ভোটগ্রহণ শেষে সেলিনা হায়াত আইভী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নির্বাচনে যে রায়ই আসুক সেটা আমি মেনে নেব। নির্বাচনের ফল নিয়ে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। ’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সব প্রস্তুতি রাখার আহ্বান জানান তিনি।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বার একাডেমি কেন্দ্রে বিকেল পৌনে ৩টার দিকে ভোট দেন। শামীম ওসমান নৌকা প্রতীকে সিল দেওয়া ব্যালটটি উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের দেখান। ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে শামীম ওসমান বলেন, ‘শত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট সম্পন্ন হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণে আন্তরিক—এটা আবারও প্রমাণ করল। কিছু মিডিয়া ভোটকে নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। নৌকা মার্কারই জয় হবে। ’
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিশুবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে ভোটগ্রহণ চলতে দেখা যায়। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে বেশ আনন্দে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছে ভোটররা। ওই কেন্দ্রের মোট দুই হাজার ৭৪০ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬০০ ভোট পড়ে তখন পর্যন্ত। অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় সেখানে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। পাশের নারায়ণগঞ্জ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভোটকেন্দ্রে দুপুর দেড়টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, স্বতঃফূর্তভাবে ভোট দিচ্ছে ভোটাররা। সেখানে দায়িত্বরত আনসার ও পুলিশ সদস্যরা ভোটারদের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে সহায়তা করেন। সব মিলিয়ে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সরকারি দলের প্রার্থীর পাশাপাশি বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পক্ষেও নির্বাচনী ক্যাম্প ছিল বেশ সরব। দুই দলের পক্ষেই নেতাকর্মীরা গলায় ফিতা ঝুলিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিজ দলের পক্ষে ভোট চাইছিল। দুই দলের কর্মীদের একসঙ্গে আড্ডা দিতেও দেখা যায়।
বন্দর শিশু নিকেতন কুমারপাড়ার ১৪৭ নম্বর ভোটকেন্দ্রে দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে গিয়ে দেখা যায়, ভোটারের সরব উপস্থিতি। সেখানে শুধু পুরুষ ভোটারদের ভোট নেওয়া হচ্ছিল। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা তিন হাজার ৫৩৬। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার জোদিষ্ঠির চন্দ্র বাড়ৈ জানান, এর মধ্যে দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট নাগাদ এক হাজার ৫৪৫টি ভোট পড়েছে, যা মোট ভোটের ৪৩ শতাংশ। ভোটগ্রহণ শেষে এই নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রটিতে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে।
বন্দর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৪৬ নম্বর কেন্দ্রে দুপুর সাড়ে ১২টায় গিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটারদের ভোট দিতে দেখা যায়। শুধু মহিলাদের জন্য ওই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা তিন হাজার ৬৪০। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার সবুর খান বলেন, ‘দুপুর ১২টা পর্যন্ত এক হাজার ২৩৬ জন ভোট দিয়েছেন, যা মোট ভোটের ৩৪ শতাংশ। কেন্দ্রের একাধিক বুথে গিয়ে জানা যায়, সাত মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে চারজন পোলিং এজেন্ট দেননি। সংরক্ষিত নারী আসনের চারজনের মধ্যে একজনের পোলিং এজেন্ট পাওয়া যায়নি। ভোট দিয়ে বেরিয়ে এসে স্বপ্না রানী বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে পেরেছি। এ ধরনের পরিবেশ ভবিষতে বজায় থাকলে নারীরা কেন্দ্রে আসতে আরো সাহস পাবে। অনেক সময় মারামারির ভয়ে নারীরা কেন্দ্রে আসতে চান না। ’
Leave a Reply