ডেইলি চিরন্তন:আধুনিক প্রযুক্তির যুগ চলছে এখন। হাল চাষ থেকে শুরু করে প্রতিটি উৎপাদনেই এখন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ম্যাজিক। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ প্রযুক্তির কল্যাণে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের গতিপথ। ছবি নির্মাণে এখন আর আগের মতো দীর্ঘসূত্রতা নেই। অনেক দ্রুত সময়ে একটি চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করে ফেলা যায় এখন। কিন্তু কই? কথাটি যেন ঢাকাই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে মানানসই নয়। চিত্রপাড়া নামে প্রসিদ্ধ এফডিসির দিকে তাকালেই চোখে পড়বে এর চিত্র। তবে ইদানীং কিছুটা উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। ফলে বেশ কিছু আধুনিক প্রযুক্তিও চোখে পড়ছে। কিন্তু হতাশা বাড়ছে অন্যদিকে। চিত্রপাড়ায় এ অগ্রযাত্রার খবর আশা জাগানিয়া হলেও নানা কারণে আটকে থাকছে অনেক ছবি। কিছু কিছু ছবি ঠিক মতো মুক্তি দেয়া হলেও কেউ কেউ ঘোষণা দিয়েই শেষ। ফলে ঝুলন্ত সিনেমার তালিকা ক্রমেই লম্বা হচ্ছে। ছবি ঝুলে যাওয়া বা শুটিং বন্ধ থাকা ছবিগুলোর এ তালিকায় অনেক জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী পরিচালকের নামও রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দুই থেকে তিন বছর বা তারও আগে শুটিং শুরু হয়েছিল এরকম সিনেমার সংখ্যা প্রায় একশরও বেশি।
এ ছবির মধ্যে কোনোটি প্রযোজকের সমস্যার কারণে আটকে রয়েছে। কোনোটি শিল্পীর শিডিউল অসুবিধায়, কোনোটি আবার কোনো অজুহাত ছাড়াই বন্ধ হয়ে রয়েছে। এর মধ্যে জি সরকারের বেশ কয়েকটি ছবির খোঁজ মিলেছে। যে ছবির শুটিং শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। আর হবে কিনা সেটিও জানা নেই কারো। এর মধ্যে রয়েছে মৌসুমী ও ফেরদৌসের ‘মায়ের মতো বোন’, আমিন খান শাবনূরের ‘লাইলী মজনু’, জায়েদ খান ও বিন্দিয়ার ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’। নায়ক মান্নাকে নিয়ে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান শুরু করেছিলেন ‘বৃষ্টির চোখে জল’ নামের ছবিটি। কিন্তু ঢাকাই ছবির দাপুটে এ নায়কের মৃত্যুর পর আটকে যায় ছবির শুটিং। এটি নিয়ে সামনে এগোনোর আর ইচ্ছা নেই বলেও জানিয়েছেন পরিচালক। ২০০৬ সালে শাকিবকে নিয়ে পরিচালক শুরু করেছিলেন ‘স্বপ্নের বিদেশ’ সিনেমার শুটিং। অর্থসহ নানামুখী সমস্যার কারণে শেষ হচ্ছে না এ ছবির শুটিং। এ সমস্যা দূর করে কবে সিনেমাটি দর্শকের মাঝে উপহার দিতে পারবেন এ নিয়ে শংকিত এবং চিন্তিত পরিচালক। শাবনূর ও ফেরদৌস অভিনীত মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘এমনও তো প্রেম হয়’ নামের একটি ছবিও আটকে রয়েছে। শাবনূর বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় থাকায় ছবিটি নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন পরিচালক। এর আগে শাবনূর দেশে থাকলেও ফিটনেসের অজুহাত দিয়ে ছবিটির শুটিং বারবার পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে ইফতেখার আহমেদ ফাহমির পরিচালনায় পূর্ণিমা ও তাহসানের ‘টুবি কন্টিনিউড’ ছবিটির দীর্ঘসূত্রতার পর কিছুদিন আগে শুটিং শেষ হয়েছে। কিন্তু ছবির মুক্তি প্রসঙ্গে ছবিটির নায়িকা পূর্ণিমা কিছুই জানাতে পারছেন না।
এ ছাড়াও অপু বিশ্বাস আড়ালে থাকায় তার অভিনীত বেশ কয়েকটি ছবির শুটিং আটকে রয়েছে। এ ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে মমতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘মাই ডার্লিং’, মান্নান সরকার পরিচালিত ‘পাংকুজামাই’, কামাল কায়সার পরিচালিত ‘মা’সহ কয়েকটি ছবি। কিন্তু সম্প্রতি এফডিসিতে পাওয়া গেল এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য।
যে কারণে ছবি মুক্তি আটকে রয়েছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) সহযোগিতায় নির্মিত হওয়া একাধিক চলচ্চিত্রের মুক্তি মিলছে না। ১৯৯৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সেন্সরের জন্য এফডিসিতে জমা পড়া ছবির প্রিন্টের হিসাব অনুযায়ী এ ছবির সংখ্যা পঞ্চাশেরও অধিক। যা এফডিসির উৎপাদন বিভাগ সূত্রের বরাতে পাওয়া গেছে। এ আটকে থাকা ছবির সবই ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম ফরম্যাটে নির্মিত। এফডিসি কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে, এসব ছবি নির্মাণে কারিগরি সহযোগিতা, ফ্লোর ভাড়া, পজেটিভ ক্রয় বাবদ ওইসব ছবির প্রযোজকদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ৫ কোটি ৫৫ লাখ ৬৪ হাজার ২৮৬ টাকা পাওনা রয়েছে এফডিসির। একেকজন প্রযোজকের কাছে এ বকেয়ার পরিমাণ সর্বনিন্ম দুই লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। এদিকে আটকে থাকা বেশ কিছু ছবি সেন্সর ছাড়পত্র পেলেও বাকি ছবিগুলো নানা ইস্যুতে এখনও ছাড়পত্রই পায়নি। এর বেশ কিছু কারণও রয়েছে। জানা গেছে, সংশোধনের মাধ্যমে আবার সেন্সর উপযুক্ত না করে বছরে পর বছর ফেলে রাখা হয়েছে ছবিগুলো। আর এসব ছবির ছাড়পত্র নিতে প্রযোজকদেরও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।
এ বিষয়ে সেন্সর না পাওয়ার তালিকায় থাকা মায়ের আঘাত ছবির প্রযোজক রাশেদুজ্জামান রাসেল বলেন, ‘এখন আর সেন্সর নিয়ে ভাবছি না। কারণ সেন্সর পেলেও তো ছবিটি মুক্তি দিতে পারব না। মুক্তি দিতে নতুন করে যে টাকা খরচ হবে, তা পুরোটাই জলে যাবে।’
তাহলে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা এসব ছবির ভবিষ্যৎ কী? এ প্রশ্নের উত্তরে এ ছবির কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলে জানানো হয়েছে। জানা গেছে, এখন এসব ছবি মুক্তি দিতে গেলে আগে এফডিসির বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। এরপর থার্টি ফাইভ থেকে ডিজিটালে পরিবর্তন করতে হবে। সেখানেও নতুন করে খরচের ব্যাপার আছে। এ ছাড়া যে প্রেক্ষাপট ধরে ছবি নির্মাণ করা হয়েছে, অনেক ছবির ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি মিলবে না। এমনকি ছবিগুলোর অভিনয় শিল্পীদেরও এখন আর দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রযোজক বলেন, ‘ছবিতে যে পরিমাণ খরচ করেছি, এখন দেনাপাওনা পরিশোধ করে ছবি মুক্তি দিতে গেলে ছবির পোস্টারের টাকাই উঠে আসবে না। আমার যা গেছে, তার সঙ্গে নতুন করে লোকসান আর যোগ করতে চাই না।’
তবে সেন্সর পাওয়া বেশ কয়েকটি ছবির প্রযোজকের ভাষ্য, এফডিসি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে তারা তাদের ছবি মুক্তি দিতে চান।
এ ব্যাপারে সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়ার তালিকায় থাকা কঠিন নারী ছবির প্রযোজক মোরশেদ খান বলেন, ‘বর্তমান সময়ে এমনিতেই চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। সেদিক বিবেচনা করে এফডিসি কর্তৃপক্ষ যদি পুরো বকেয়া মাফ করে দেয়, তাহলে আমার ছবিটি মুক্তি দিতে চাই। আমি জানি, অনেক দিন আটকে থাকার কারণে এ ছবি থেকে বিনিয়োগের কোনো টাকাই উঠে আসবে না।’
কীভাবে আছে আটকে থাকা সরকারি অনুদান পাওয়া ছবি: ২০০৭-০৮ অর্থবছরে অনুদান দেয়া হয় ‘নমুনা’ নামের একটি চলচ্চিত্রকে। যেটি পরিচালনা করেছেন এনামুল করিম নির্ঝর। ছবিটি এখনও মুক্তি পায়নি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের অনুদান পাওয়া জুনায়েদ হালিমের ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের গল্প’ ছবিটি নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় এটির মুক্তি নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়া ২০১০-১১ অর্থবছরে ফারুক হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ ও মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘ধোঁকা’ ছবিগুলোও একই অবস্থায় রয়েছে। এদিকে ২০১১-১২ অর্থবছরে মারুফ হাসান আরমানের ‘নেকড়ে অরণ্যে’, প্রশান্ত অধিকারীর ‘হাডসনের বন্দুক’, সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকীর ‘একা একা’, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ক্যাথরিন মাসুদের ‘কাগজের ফুল’, নারগিস আক্তারের ‘যৈবতী কন্যার মন’, খান সরফুদ্দিন মোহাম্মদ আকরামের ‘খাঁচা’, টোকন ঠাকুরের ‘কাঁটা’, ২০১৩ ড্যানি সিডাকের ‘কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ’, ড. সাজেদুল আওয়ালের ‘সিটকিনি’ ও জানেসার ওসমানের ‘পঞ্চসঙ্গী’ ছবিগুলোও অন্ধকারে রয়েছে। অনুদানের অর্থে নির্মিত এসব ছবি কবে আলোর মুখ দেখবে, কিংবা আদৌ দেখবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
এদিকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে অনুদান পায় ড. সাজেদুল আওয়ালের ‘সিটকিনি’ ছবিটি যে ছবিটির কাজ এখনও শেষ হয়নি বলেই জানা গেছে। মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র অনুদানের প্রথম চেকপ্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে ছবি নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু কই কে শোনে কার কথা!
Leave a Reply