বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেওয়ার কারণে সমবেদনা জানাতে গিয়ে ফিরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুত্রশোকে কাতর বেগম খালেদা জিয়াকে তাই সমবেদনা জানানো হলো না তার। গত রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সামনে আসেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি গাড়ি থেকে নেমে দলের সিনিয়র নেতাদেরসহ ভিতরে প্রবেশের জন্য গেটের সামনেও আসেন। সেখানে তিনি সাত মিনিট অপেক্ষাও করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানান, গেট ভিতর ও বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভিতরে অবস্থান নিয়ে আছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বিস্ময় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গাড়িতে ওঠেন। ফিরে যান গণভবনের উদ্দেশে।
জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে পৌঁছে প্রথমেই গাড়ি থেকে নেমে ফটকের দিকে হেঁটে যান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সেখানে গিয়ে তালা দেখে বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলেন তারা। শিমুল বিশ্বাস তাদের জানান, খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, তারা কেউ তার কাছে যেতে পারছেন না। মূল ফটকের ভিতরে ও বাইরে খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যদের দুটি গাড়ি প্রধানমন্ত্রীর যাওয়ার খবর জানাজানি হওয়ার পরও আড়াআড়িভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। যেগুলো বেশ কয়েক দিন ধরে একই অবস্থানে দেখা গেছে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক শাকিলের কাছ থেকে অবহিত হয়ে শেখ হাসিনা গাড়ি থেকে নেমে ফটকের দিকে হেঁটে যান। এ সময় তার নিরাপত্তায় থাকা এসএসএফ সদস্যরা ফটকে নাড়ানাড়ি করে ফিরে এলে ৮টা ৪২ মিনিটের দিকে প্রধানমন্ত্রী গাড়িতে উঠে বসেন। রওনা দেন গণভবনের দিকে। জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, বিএনপি চেয়ারপারসনকে শোক ও সমবেদনা জানাতে রাত ৮টায় গুলশান যাবেন তিনি। এ ঘোষণার পরই প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এসএসএফ ও পিজিআর সদস্যরা গোটা গুলশান এলাকা কর্ডন করে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেন। ৮টার পরপরই গুলশান কার্যালয়ের সামনে এসে পৌঁছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রধানমন্ত্রী এসে পৌঁছার কয়েক মিনিট আগেই বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস গণমাধ্যমের সামনে আসেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুশোকে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এপিএস আমাদের ফোন করেছিলেন। আমরা জানিয়েছি, খালেদা জিয়া সুস্থবোধ করলেই আমরা তাকে জানাব। ম্যাডামের সঙ্গে আলোচনা করে সময়-সুযোগ বুঝে কখন দেখা করা সম্ভব তা জানিয়ে দেব।’ প্রধানমন্ত্রী শোকগ্রস্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় ধন্যবাদও জ্ঞাপন করেন তিনি। শিমুল বিশ্বাসের এই বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাঝপথে। এর কিছুক্ষণ পরই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর এসে পৌঁছায় গুলশান কার্যালয়ের সামনে। তিনি গাড়ি থেকে ধীর পায়ে নেমে আসেন। ভিতরে প্রবেশের জন্য প্রায় সাত মিনিট অপেক্ষাও করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহর গুলশান কার্যালয় ত্যাগ করার পর তার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী একজন মা হিসেবে মানবিক কারণে আরেক মায়ের ছেলের মৃত্যুর সংবাদে এসেছিলেন। তিনি সমবেদনার জন্যই এসেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো না। প্রধানমন্ত্রী চলে আসার পরও গেট বন্ধ থাকায় ফিরে গেছেন তিনি; যা একটি লজ্জাজনক ও অমানবিক কাজ। শুধু রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূতই নয়, এটি দুঃখজনকও।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি নেত্রীকে সমবেদনা জানাতে গুলশান কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী আসবেন বিকালে সে বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তার পরও যখন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং চলে এলেন তখনো সাক্ষাৎ দেওয়া হলো না।’ এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে গুলশান কার্যালয়ের আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। শেখ হাসিনা আসার আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে গুলশান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন এসএসএফসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় বিএনপি নেতা-কর্মীদের কার্যালয়ের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য ভিতরে দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকশ নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও বেগম জিয়ার আত্মীয়স্বজনরা শোক জানাতে গুলশান কার্যালয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর আবারও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন শিমুল বিশ্বাস। এ সময় তিনি শোকবই হাতে নিয়ে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যখন আসেন খবর পেয়েই আমি গেটের সামনে গিয়েছি। শোকবই নিয়ে এসেই দেখি, প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন। এটা নিয়ে তার অফিসের কেউ কেউ নানারকম কথাও বলেছেন। তাদের প্রতি আহ্বান- আমাদের এই শোকের দিনে নোংরা রাজনীতি করবেন না।’ এদিকে প্রধানমন্ত্রীকে কার্যালয়ের ভিতরে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় বাইরে থাকা বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল। অনেকেই আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু কার্যালয়ে চলেই এসেছেন, তাকে সম্মানের সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত ছিল। তার ফিরে যাওয়াটা দুঃখজনক। ২০০৯ সালের মে মাসে শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর ধানমন্ডির সুধাসদনে গিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমবেদনা জানান এবং দুই নেত্রীর মধ্যে কিছুক্ষণ কথাও হয়। এরপর বেশ কয়েকবার একই অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও তারা কথা বলেননি। ২০১৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর শোক জানাতে বঙ্গভবনে দুই নেত্রী গিয়েছিলেন। অবশ্য সে সময় কথা হয়নি তাদের মধ্যে। এ ছাড়া বিগত কয়েক বছরে একাধিকবার সশস্ত্রবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে সেনাকুঞ্জে গেলেও কথা বলেননি তারা। এর আগে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিয়েতে বিএনপি-প্রধানের বাসায় গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার সেই কোকোর মৃত্যুতেই খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে যান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ঘুমের ইনজেকশন নিয়ে খালেদা জিয়া ঘুমিয়ে থাকায় এবার দেখা-সাক্ষাৎ হলো না।
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানালেন খালেদা জিয়া : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। রাত সাড়ে ১১টার দিকে চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সাংবাদিকদের জানান, বেগম খালেদা জিয়াকে সববেদনা জানাতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন। এটা কিছুক্ষণ আগে ম্যাডামকে জানানো হয়েছে। এ কথা শুনে ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
Leave a Reply